পুকুর পেয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছেন আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী
সাতক্ষীরার, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরির পর থেকে সরকারিভাবে ২ বিঘার একটি পুকুর খনন করা হয়। পুকুরটি আশ্রয়ন প্রকল্পের জন্য খনন হলেও সেটি আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী ব্যবহারের অধিকার ছিলো না। পার্শ্ববতী একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি দখল নেন। এ বিষয় ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি ও স্থানীয় ইউপি সদস্যের সাথে আলোচনা করেও কোন লাভ হয়নি। একপর্যায়ে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী এ সমস্যা সমাধানের জন্য বারসিক’র নিকট সহায়তার দাবি জানান। বারসিক সহায়তায় ধারবাহিকভাবে পুকুরের সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও স্থানীয় সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হয়। একপর্যায়ে ২০১৭ সালের দিকে উপজেলা প্রশাসন থেকে তদন্ত হয় এবং প্রভাবশালীকে নোটিশ প্রদান করা হয় পুকুরের দখল ছেড়ে দেওয়ার জন্য। পরবর্তীতে প্রভাবশালী হাইকোর্টে আপিল করে পুনরায় আবারও পুকুর দখল নেন। তারপরও আশা ছেড়ে না দিয়ে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী বারসিক সহায়তায় স্থানীয় সকরার, উপজেলা প্রশাসন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্টানের সাথে ধারবাহিক যোগাযোগ রাখে। যার ফলশ্রুতিতে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তি ১০ কাঠার মতো পুকুরের অংশ বের করে দিতে সম্মত হয়। সেখানে‘ শুধু মাত্র আশ্রয়ন প্রকল্পের সীমানা নির্ধারণ হয়। কিন্তু সীমানা বরাবর কোন বাঁধ থাকেনা। বাঁধ না থাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তি মাছ ছাড়েন এবং নিজে ব্যবহার করে।
ফলে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী পুকুরের কোন অংশ ভোগ করতে পারতেন না। কারণ তখন প্রভাবশালী ব্যক্তির মাছ ছাড়া ছিলো। পুকুর খনন ও সীমানা বরাবর বাঁধ না থাকায় আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর গোসল, কাপড়-চোপড় পরিস্কার, থালা-বাসন ধোয়া, কৃষি কাজসহ প্রভৃতি কাজের খুব সমস্যা হচ্ছে। মাঝে মাঝে নদীর পানি ও অন্যের পুকুর ব্যবহার করতে হচ্ছে। সুপেয় পানি দূরের গ্রামের দেড় কিলোমিটার দূর থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এমতাবস্থায় ব্যারাকের পুকুরের সীমানা বরাবর বাঁধ নির্মাণ, পুনঃখনন, পাড় মেরামত না করা হলে তাদের বসাবাস করা খুবই কঠিন হয়ে ওঠে। সর্বশেষ ২০২২ সালে স্থানীয় সরকারের সহায়তায় পুকুরটি খনন এবং সীমানা বরাবর বাঁধ নির্মাণ হয়। যেখানে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর বসতভিটায় সবজি তো দূরের কথা পুকুরের পানি ব্যবহার করতে পারতো না। এখন তারা কিছু সবজি চাষ করার চেষ্টা করছেন এবং পুকুরে মাছ চাষ করছে। পুকুর পুনঃখনন ও সীমানা বরাবর বাঁধ নির্ধারণ করার কারণে কিভাবে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় ফসল ও খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রেখেছে উপরোক্ত বর্ণনায় সেটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুভিটা বিচ্ছিন্ন একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র নুরনগর ইউনিয়নের সৈয়দালিপুর গ্রামের আশ্রয়ন প্রকল্প। ২০০৭ সালের দিকে উপজেলা ও ইউনিয়ন দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তে দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অবহেলিত পরিবারদের আশ্রয়ের জন্য সরকারিভাবে ব্যারাকটি তৈরি করা হয় নুরনগর ইউনিয়নের সৈয়দালীপুর গ্রামে মাদার নদীর চরে ১ একর জায়গার উপর। একটি শেডে ১০টি ঘর তৈরি করা হয় এবং ২ বিঘার ১টি পুকুর খনন করা হয়, যা স্থানীয়ভাবে ১০ ঘর নামে পরিচিত।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার ২টি ইউনিয়নের ৩টি গ্রামের ১০টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়। আইলা ঘটে যাওয়ার এই দীর্ঘ সময় পরও নিজেদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে না পেরে আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাস করছে তারা।
ব্যারাক নির্মাণের শুরুতে পুকুরটি সম্পূর্ণরূপে খনন না হওয়ায় এবং অন্যের দখলে থাকায় পানি ব্যবহার এবং ফসল চাষের পরিবেশ তৈরি করা করা সম্ভব হয়নি। পুকুর পুনঃখনন এবং সীমানা বরাবর বাঁধ নির্মাণ করায় সবজি চাষ, ফলজ গাছ এবং পুকুরে মাছ চাষ করার চেষ্টা করছেন তারা।
এ বিষয়ে আশ্রয়ন জনগোষ্টী ফিরোজা, আশরাফরা জানান, ‘কোন দিনে যে আমাদের নিজেদের পুকুর হবে আর সেই পুকুরে মাছ চাষ করবো নিজেদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারবো এটা কোন দিন ভাবেনি। অবশেষে আমাদের সেই আশা পূরণ হলো। আমরা এখন কিছুটা সবজি চাষ করতে পারছি, পুকুরের পানি ব্যবহার করতে পারছি, পুকুরে মাছ চাষ করে যেমন পুষ্টি চাহিদা পূরণ করছি তেমনিভাবে মাছ বিক্রি করে সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতে পারছি। গতবারের মাছ বিক্রি করে ৫৫০০ টাকার একটি পাইপ ক্রয় করেছি পুকুরের অতিরিক্ত পানি বের করার জন্য। কারণ প্রতিবছর এখানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় সেটি যাতে না সে জন্য এ উদ্যোগ নিয়েছি।’
অন্য আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী জাগাঙ্গীর ও মমতা জানান, ‘আমাদের আশ্রয়ন প্রকল্পের এখনো অধিকাংশ জায়গা নিচু মাটি দিয়ে উচু করতে হবে। এখানে মাটি দিয়ে উচু করলে আমরা ১২ মাস সবজি চাষ ও ফলজ গাছ লাগাতে পারবো। যতটুকু হয়েছে সেটি আমরা ফসল উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছি, যা পারিবারিক খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পারিবারিক আয়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। এছাড়া পুকুরে বৈচিত্র্র্যময় মাছ চাষের সুযোগও তৈরি হয়েছে। পুকুর পেয়ে নতুন করে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছি আমরা।’
আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা উন্নয়নের ক্ষেত্রে আশ্রয়ন প্রকল্পের পুকুর একটি বড় ভূমিকা রাখে। তাই আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর উদ্যোগ সহযোগিতা আশ্রয়ন প্রকল্পকে প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করেছে, নিরাপত্তা দিতে চেষ্টা করেছে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর পরিবারের খাদ্য চাহিদা।