গরিবের ঢোক মেটায় ঢোপকল
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
‘‘আমার নিজের কোন জমি নেই এই শহরে। রাস্তার পাশে থাকি ঝুপড়ি ঘরে। সকাল, বিকাল ও রাত সবসময়ই ঢোপকল থেকেই পানির তিয়াশা (পিপাসা) মেটাই, এটি না থাকলে আমরা বাঁচতে পারতাম না। কয়েকবছর আগে এটি ভেঙে ফেলতে এসেছিলেন সরকারি লোকজন। আমরা সবাই বাধা দিয়ে ভাঙা বন্ধ করেছি।”
উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর শহরের ফুদকিপাড়ার মিনতি রাণী (৪৫)। মিনতি রানীর ৫ সদস্যের সংসার। স্বামী অটোরিকসা চালায়, থাকেন পদ্মার পাশে একটি ঝুপড়ি ঘরে। প্রতিদিন রোজগার করে যে টাকা অর্জন করেন তা দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকার মতো সামর্থ্য নেই মিনতিদের উপরোন্তু সুপেয় পানি কেনার! তাই পারিবারের সবটুকু পানি তারা শিবমন্দিরের ঢোপকলটি থেকেই সংগ্রহ করেন। শিবমন্দীরের বটতলার পাশে এই ঢোপকলটির পানি দিয়ে চাহিদা মেটান প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি পরিবার। শুধু এই পরিবারগুলোই নয়; এই ঢোপকলটি থেকে পানির চাহিদা মেটান পথচারী, রিকসা চালকসহ আশপাশের পাড়ার অনেক দরিদ্র পরিবার। যাদের পানি কিনে খাবার কোন সামর্থ্য নেই। রিকসা চালক আ: জব্বার (৪৭) ঢোপকলের পাশে রিকসা থামিয়ে বোতল ভর্তি করে পানি সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, “আমি যখনই সাহেব বাজার আসি সুযোগ পেলেই আমি এই ঢোপকলের পানি বোতলভর্তি করে নিয়ে যাই। বাড়িতে যাবার সময় বেশি করে বড়ো বোতল ভর্তি করে নিয়ে যাই। আমার পরিবারও এই পানি পান্ করে।” তিনি আরও বলেন, “ঢোপকলের পানি ঠান্ডা এবং অনেক পরিষ্কার হওয়ায় স্বাদ বেশি লাগে। একসময় রাজশাহীর সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে এই ঢোপকলগুলো বসানো হয়েছিলো। পথচারীসহ সকল পেশার মানুষের পানির একমাত্র উৎস ছিলো এই ঢোপকলগুলো। কিন্তু আধুনিক নগরায়ন এবং পানি বাণিজ্যের কারণে পরিচর্যার অভাবে এই ঢোপকলগুলো দিনে দিনে নষ্ট হয়ে গেছে বা ধ্বংস করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে রাজশাহীর নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এর আহবায়ক এ্যাডভোকেট এনামুল হক বলেন, “গরিবের পানি প্রাপ্তির উৎসগুলো দিনে দিনে নষ্ট করা হচ্ছে, পাশের নদীকেও মেরে ফেলা হচ্ছে। গরিব মানুষের সকল উৎস এভাবেই ধ্বংস হচ্ছে। এগুলো রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।” তিনি রাজশাহীর সকল ঢোপকল আবার চালু করার দাবি জানান।
জানা যায়, ঢোপকলগুলো স্থাপন করা হয় ১৯৩৭ সালে। সেসময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির খুব কষ্ট ছিল। বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব ছিলো তখন। ফলশ্রুতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা, আমাশয়সহ নানারকম পেটের পীড়া। বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনা নাকি ঘটেছিলো তখন! জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর জিরো পয়েন্টের “সোনাদীঘী” খনন করা হয় শুধুমাত্র পানযোগ্য পানি পাওয়ার জন্য। এই দীঘির পানি খুবই টলটলে ছিল। তবে এখন সেই দীঘিটি থাকলেও পানির সেই রূপ আর নেই। ঢোপকলগুলো লম্বায় প্রায় ভূমি থেকে ১২ ফুট উঁচু এবং ব্যাস প্রায় ৪ ফুট। ঢোপকলগুলো তৈরি করা হয়েছিল সিমেন্টের ঢালই করে। এই ঢোপকলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো একটা প্লাস্টার করা হতো। যে নকশাটা করা হতো টিনের সাহায্যে। চারিদিকে টিনের একটা রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর ইটের খোয়ার ঢালাই ঢেলে দেওয়া হতো। এর ঢালাই খুবই শক্ত। সহজে কোন কিছুর ধাক্কায় বা আঘাতে এটা ভাঙে না। এগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সাপ্লাই করা হতো এবং সেখান থেকে এলাকাবাসী পানি সংগ্রহ করতো।
সেই সময় ঢোপকলে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার পাইপগুলো ছিল কাস্ট আয়রনের এবং অন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো ছিল পিতলের তৈরি। সিমেন্টের তৈরি ঢোপকলগুলো ব্যতীত অন্য সবকিছুই ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিলো। সেসময় হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কসে প্রতিদিন ভূ-গভর্স্থের পানি শোধন করা হতো। এই পানি শোধন কেন্দ্রে আয়রন, ম্যাংগানিজ ও পানির ক্ষার দূর করার ব্যবস্থা ছিল। এই শোধিত পানি রাজশাহী নগরের মোড়ে মোড়ে স্থাপিত ১০০টিরও বেশি ঢোপকলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে সরবরাহ করার ব্যবস্থা নেওয়া হতো। ঢোপকলের প্রতিটির পানি ধারণক্ষমতা হচ্ছে ৪৭০ গ্যালন। এগুলোর প্রতিটিই ছিল একটি ‘রাফিং ফিল্টার’। এতে বালি ও পাথরের স্তর ছিল যাতে সরবরাহকৃত পানি আরও পরিশোধিত হয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে। সেসময় সারাদিনে মাত্র দুই ঘণ্টা পানি সরবরাহ করা হতো। এ জন্য প্রতিটি ঢোপকলকে পানি রিজার্ভ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
ঢোপকলগুলো তৈরির সেসময়ে রাজশাহী পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন রায় ডি এন দাশগুপ্ত। তিনি তখন অনুভব করেন অতিসত্ত্বর এলাকাবাসীর জন্য কিছু একটা করার। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে এমন পানির কল স্থাপন করার। ১৯৩৭ সালের আগস্ট মাসে মিনিস্ট্রি অব ক্যালকাটার অধীনে রাজশাহী ওয়াটার ওয়াকর্স নামে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ব্যয় করা হয় প্রায় আড়াই লক্ষাধিক টাকা। এই কাজে নগরীর নামকরা বড়লোকেরা এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। সেই সূত্র ধরেই মহারাণী হেমন্তকুমারী নিজেই দান করেন প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। তার নাম অনুসারেই এই প্রকল্পের নাম রাখা হয় “হেমন্তকুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস”। কালক্রমে তার নাম “হেমন্তকুমারী ঢোপকল” নামেই পরিচিত হতে থাকে। যুগ যুগ ধরে এই ঢোপকলগুলোর সেবা পেয়ে এসেছে রাজশাহীর মানুষ। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো ঢোপকলগুলো রাজশাহীবাসীর কাছে এতটাই পরিচিত দৃশ্য যে, অনেকের কাছেই ঢোপকল ছাড়া রাজশাহীকে ভাবাই যেতো না।
কিন্তু আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনা এবং মানুষের আধুনিক জীবন ব্যবস্থার কারণে দিনে দিনে সাধারণ মানুষের জলের আধার হিসেবে পরিচিত ঢোপকলগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ইদানীং রাস্তার সম্প্রসারণ ও নানা উন্নয়নমূলক কাজের নামে এই ঢোপকলগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। অন্যদিকে কিছু কিছু ঢোপকলে পানি সর্বারাহ না করার কারণে সেগুলোও দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথেই পাল্টে যাচ্ছে রাজশাহীর সেই পুরাতন ঐতিহ্যবাহী রূপ ও রঙ। এখনও বেশ কিছু ঢোপকল রাজশাহীর আনাচে কানাচে রয়ে গেছে। কিছু ঢোপকলে এখনও পানি আসে। সাধারণ মানুষ এখনও এই ঢোপকলগুলোয় পানির জন্য ভিড় করে। তাদের কাছে এই ঢোপকলগুলোই পানির একমাত্র উৎস তাঁদের। পথচারী থেকে শুরু করে শহরের প্রান্তিক মানুষ যারা বস্তির কিংবা রাস্তার পাশে ঝুপরি ঘরে বসবাস করে তাদের একমাত্র ভরসা এই ঢোপকলগুলো।
বোয়ালিয়া থানার পূর্ব প্রাচীর ঘেঁষে রয়েছে একটি ঢোপকল। একসময় বিনামূল্যে বিশুদ্ধ পানির একমাত্র উৎস হিসেবে এই ঢোপকল ব্যবহার করা হতো। তবে এটিসহ রাজশাহী মহানগরের প্রায় সব ঢোপকল দিয়েই পানি বের হয় না। তাই বোয়ালিয়া থানা সংলগ্ন ঢোপকলের জায়গাটি ঘিরে স্থানীয় নগেন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছেন চা-শিঙ্গাড়ার দোকান। ঢোপকলের বিষয়ে জানতে চাইতেই নগেন্দ্রনাথ বললেন, “আগে কত সহজে পানি পাওয়া যেত। গরিব মানুষের কত উপকার হতো। এখন আর পানি আসে না। গরমের দিন পানির জন্য গরিব মানুষ হাহাকার করে মরে।” ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে এই ঢোপকলগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করার দাবিও জানান তিনি। আমরাও মনে করি, দরিদ্র মানুষের জন্য সুপেয় পানির সহজলভ্য করে তোলা এবং রাজশাহী ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এই ঢোপকলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন রয়েছে।