সাম্প্রতিক পোস্ট

নারীদের সম্পৃক্ততায় রচিত হবে উৎসাহের আগামী

ঢাকা থেকে ফেরদৌসি আকতার

“আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। শিশুর জন্য পিতা-মাতা উভয়েই সমান দরকার। কি আধ্যাত্মিক জগতে, কি সাংসারিক জীবনের পথে সর্বত্র আমরা যাহাতে তাহাদের পাশাপাশি চলিতে পারি, আমাদের এরূপ গুণের আবশ্যক। এরূপ গুণ অর্জন তথা একজন স্বাধীন বা মুক্ত মানুষ হয়ে উঠতে নারীকে কি করতে হবে?….আমরা পুতুল জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্টি হই নাই, এ কথা নিশ্চিত (স্ত্রী জাতির অবনতি)…যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে; যেন নিন্দা-গ্লানি উপেক্ষা-অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে; মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে, যেন খড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র বিদ্যুৎ সকলেই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’

বেগম রোকেয়া’র চলে যাবার ৮০ বছর পরও তার উদ্ধৃতি দিয়েই লেখাটি শুরু করার প্রয়োজন বোধ করছি। একবিংশ শতাব্দীতে পা রেখে আমাদের চেতনায়, মননে ও চর্চায় বেগম রোকেয়ার কথাগুলোকে আজও আমরা ইতিহাস বানাতে পারিনি। এই ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে নারী অধিকার এর যৌথ মঞ্চে বারসিক এর সকল সহকর্মীদের পক্ষে লাল সালাম। আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ নারী জাতির অধিকার আদায়ের প্রথম মঞ্চ। এই মঞ্চ তৈরিতে ক্লারা জেৎকিন থেকে শুরু করে বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতা, রোসা লুক্সেমবার্গ, মাতঙ্গিনী হাজরা, সরলা দেবী, সরজিনী নাইডু, মনোরমা বসু, লীলা নাগ, বেট্টি ফ্রিডেন, গীতা মুখার্জী, সুফিয়া কামাল, হেনা দাসসহ নাম না জানা হাজার হাজার নারীর অবদান রয়েছে। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সময়ে  আমাদের পথ দেখিয়েছে শ্রদ্ধেয় সংগ্রামী নারীরা। যারা একই সাথে নারী অধিকার’র শ্লোগান তুলে যেমন প্রতিবাদী হয়েছেন তেমনি তারা সমগ্র বিশ্বে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে পথে নেমেছেন। তার প্রতিফলন বা অর্জন আজকের সভ্য সমাজ।

women-2১৯১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল আমাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা-সব মিলিয়ে এগিয়ে গেছি বলে আমরা দাবি করি। কিন্তু যাদের অর্ধেক অবদানে আজকের এই এগিয়ে যাওয়া সেখানে কোনো পরিবর্তন এসেছে কতখানি? গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের কোটি মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারীরা এখনো পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক পরিচালিত ‘নারী ব্যবসা এবং আইন ২০১২’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজের ৬৬ শতাংশ করেন নারীরা, খাদ্যের ৫০ শতাংশও তারা উৎপাদন করেন। অথচ  বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ সম্পত্তির মালিক নারীরা। ১৪১টি দেশের উপর গবেষণা চালিয়ে নারীর অবস্থার ও চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। বলা হয়, বেশিরভাগ দেশে নারীর জীবনযাত্রা পুরুষের চেয়ে এখনো অনেক কঠিন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নারীরা বিশ্ব জনসংখ্যার ৪৯.৬ শতাংশ অথচ শ্রমশক্তি হিসেবে রয়েছে মাত্র ৪০.৮ শতাংশ। বেসরকারি সংস্থা ডাব্লিউবি ট্রাস্টের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি নারী নিজের সংসারে শ্রম দিচ্ছেন। দেশের মোট নারীর ৮২ শতাংশই নিজের ঘরে শ্রম দেন। একটি পরিবারে গৃহস্থালির এসব কাজ বিভিন্ন পেশাজীবীর মাধ্যমে করতে গেলে সেখানে মাসিক খরচ দাঁড়াবে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। কর্মজীবী নারীর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিকের কোনো আইনি স্বীকৃতি বা সুরক্ষা নেই। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৮.১ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত এবং মোট নারী শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে তা ৬৮.১ শতাংশ এবং মোট পুরুষ শ্রমশক্তির ৪১.৮ শতাংশ।

এবারের (২০১৬) আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো “অধিকার মর্যাদায়, নারী- পুরুষ সমানে সমান”। এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখেই দেশব্যাপী নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্টদের চাপ দেওয়া এবং সর্বস্তরের মানুষের ভেতরে সচেতনতা তৈরি করা। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেসব বাধা, প্রতিকূলতা রয়েছে সেগুলো প্রশমনে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য নানানভাবে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। নারী ও শিশু নির্যাতন, নারী-পুরুষের কাজের সমমজুরি, বাল্য বিবাহ রোধসহ পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন এবং সমাজ বির্নিমাণে নারীকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। এছাড়া, কৃষি থেকে শুরু জীবন ও জীবিকা সর্বস্তরেই নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। শুধু বাংলাদেশেই নয় সারাবিশ্বে নারীর মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করার প্রক্রিয়া এখনও বিদ্যমান। পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে নারীকে পুরুষের অধঃস্তন হিসেবে দেখার মানসিকতা এখনও রয়েই গেছে। সেক্ষেত্রে অধিকা বা মর্যাদায় নারীাকে পুরুষের সমান করে তোলার জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে। নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিতে নারীকে কৃষক হিসেবে দেখতে কেউ রাজি নয়; অথচ কৃষির বেশির ভাগ কাজই নারীকে করতে হয়। নারীর কাজকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মানদ-ে বিচার না করে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। শুধুমাত্র আয়মূলক কাজের সাথে জড়িত হওয়ার কারণে পুরুষের কাজকেই বড় করে দেখা হয়; অথচ নারীর গৃহস্থালি, সন্তান দেখাশোনাসহ অন্যান্য কাজকে অর্থনৈতিক মানদ-ে পরিমাপ করা হলে নারী পুরুষের চেয়ে এগিয়ে থাকবে এটা নিশ্চিত। তাই পুরুষের সমানতালে নারীর অধিকার ও মর্যাদাকে তুলে ধরতে হলে নারীর সামাজিক, অর্থতৈকি ও মনস্তাত্ত্বিক অবদানকে বিবেচনায় আনতে হবে।

happy wheels 2