স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অচাষকৃত উদ্ভিদ ব্যবহার
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী:
এখনও গ্রামবাংলার অনেক নারী আছেন যারা জীবনের প্রয়োজনই বাড়ির আশেপাশে, পুকুর পাড়ের রাস্তারধার,নদী, নালা, খালবিল, হাওর-বাওর, বনবাদার, পাহাড়, খানাখন্দ এবং জলাশয় থেকে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য থেকে পূরণ করেন পুষ্টির অভাব, বাঁচিয়ে রাখেন কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যের ভান্ডারকে।
এরকমই একজন নারী মালা আক্তার (৩৮)। নেত্রকোনা সদর উপজেলায় কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামে বসবাস করেন তিনি। তিনি বাড়ি আশে পাশে কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজি যেমন: থানকুনি, হেলঞ্ছা, গিমাই, হেইচা, দলকলস, কচুশাক, বাউত্তা, পালই, কলমী, কেউরালি, শাপলা, শালুক, ইত্যাদি ইত্যাদি সংগ্রহ করে পরিবারের সবজি চাহিদা পূরণ করেন। এই প্রসঙ্গে মালা আক্তার বলেন, ‘আমার বাচ্চাদের কুড়িয়ে (টুকাইয়া) শাক রান্না করে খাওয়াই। করোনার পরিস্থিতিতে কুড়িয়ে প্ওায়া শাকসবজি খেলে রোগবালাই কম হয় বলে অনেকে বলেন। এজন্যই আমি এসব কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজি সংরক্ষণ করি এবং সংরক্ষিত এসব শাকসবজি দিয়েই পরিবারের সবজি চাহিদা পূরণ করি। আমার পরিবারের সদস্যদের রোগবালাই হয়ইনা বললেই চলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগে আমি আমার মা, চাচীদেরও দেখতাম সব সময় টুকইয়া শাক রান্না করে আমাদের খাওয়ইতো। আমি আগেও জানতম অচাষকৃত উদ্ভিদের পুষ্টি সম্পর্কে, কিন্তু কারো সাথে আলোচনা করতাম না। কারণ টুকাইয়া পাওয়া শাক খাওয়ার কথা শুনলে কেমন যেন শরম লাগত। সংগঠনের সভায় কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজি পুষ্টি গুনাগুণ ও ঔষধি গাছের উপকারিতা সর্ম্পকে আলোচনা করার পর থেকে আর যেন শরম লাগে না।’ মালা আক্তার বলেন, ‘কুড়িয়ে শাকসবজি শীতকালে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত কিন্তু এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। অতিরিক্ত বিষ ব্যবহারের কারণে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে আমার মনে হয়।’ মালা আক্তার যেখানে ঔষধি গাছ পান সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে বাড়ির আশেপাশে লাগিয়ে দেন। তার বাড়িতে আট জাতের ঔষধি গাছ ও অচাষকৃত উদ্ভিদ আছে।
মালা আক্তার জানান, রহিমা আক্তার শরীরের পোড়া হয়েছিল। কলমি শাক বেঁটে পোড়া চারপাশে লাগিয়ে দেওয়া পর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন পোড়া পেকে গেছে। তারপর আর অপারেশন করা প্রয়োজন হয় নাই। কাশি হলে কখনও ডাক্তার প্রয়োজন হয় না তাঁর। তুলসি পাতা, বাসকপাতা খেয়ে ভালো হন বলে তিনি জানান। তাই তো সবাইকে ওষুধি গাছের ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
নতুন প্রজন্ন কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজি অনেকেই চিনে না। মালা আক্তার নিজ উদ্যেগেই কুড়িয়ে পাওয়া শাক সবজির পুষ্টি ও গুনাগুন সর্ম্পকে তাদের সাথে আলোচনা করেন যাতে করে তারা এসব ওষুধি গাছের গুনাগুণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। মাল আক্তারের মতে, চাষকৃত শাক সবজির তুলনায় বাড়ি আনছে কানাছে কুঁিড়য়ে পাওয়া শাকসবজির গুণাগুণ ও পুষ্টিমান অনেক বেশি। যেসব শাক সবজি আমরা সাধারণত চাষ করি না সেগুলোকেই কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজি বলা হয়। এসব কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজিতে অনেক পুষ্টিমান রয়েছে। আগেকার যুগের মা, চাচীরা কুঁড়িয়ে পাওয়া শাক রান্না করে তারা নিজেরা ও তাদের সন্তানদের খাওয়াতেন এবং তখন রোগবালাই হলে ঔষধি গাছ ব্যবহার করতেন বলে মালা আক্তার জানান। এই প্রসঙ্গে মালা আক্তার বলেন, ‘আমি আমার মায়ের কাছ থেকে ছোটবেলা থেকেই কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজির গুণাগুণ সম্পর্কে জেনেছি। সংসারের খরচ বাঁচাতে এবং নিজেদের সুস্থ রাখতে হলে বিষমুক্ত শাকসবজি চাষ করতে হবে। বিষমুক্ত শাক সবজি খাওয়ার ফলে আমার পরিবারে কোন গ্যাস হয় না, কোন ঔষধও খেতে হয় না এবং ডাক্তারের প্রয়োজন হয় না। আমার মা, চাচীরা বলে গেলে ডাক্তারের কাছে যান কম। কারণ ঔষধি গাছ ও কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজি তাদের বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত রেখেছে।’
করোনার পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জন্য মালা আক্তার অচাষকৃত উদ্ভিদ ব্যবহার করেন বলে জানান। তার মতে, থানকুনি (টুনিমাহন) গাছ খেলে পেট ফোলা, বদহজম, আমাশয় ও গ্যাস্ট্রিক ভালো হয়। বাসক পাতা ও তুলসি পাতার রস খেলে কাঁশি ও জ¦ও ভালো হয়। কলমী শাক খেলে একজন গর্ভবতী মায়ের বুকের দুধ বাড়ে ও শারীরিক দুর্বলতা কম হয়। হেলঞ্চি খেলে রুচি বাড়ে ও বদহজম দূর হয়। মালা আক্তার জানান, এসব লোকায়ত চর্চার কারণে করোনার পরিস্থিতিতে তাদের সংগঠনের সদস্যদের কোন ডাক্তারের প্রয়োজন হয়নি। নিজের অভিজজ্ঞতা থেকেই করোনার পরিস্থিতিতে মালা আক্তার কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজি মানুষের খাওয়ানোর পরামর্শসহ পশুপাখির খাদ্য ও চিকিৎসায় ব্যবহারে সবাইকে উৎসাহিত করেন।