স্কুল-গেইটে অপেক্ষামান ‘মা’ মোমেনা বেগম এখন পোষাকশিল্পের উদ্যোক্তা
চট্টগ্রাম থেকে সৈয়দ মামুনুর রশীদ
সহজ সরল নারী মোমেনা বেগম, ডাকনাম হাসু। চট্টগ্রাম নগরীর নেভিগেইট এলাকায় একটি স্বনামধন্য স্কুল-গেইট থেকে তার ব্যবসা শুরু। ব্যবসা শুরুর আগে মোমেনা ইয়াং ওয়ান গ্রæপের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কিউসি পদে চাকরি করতেন। কুমিল্লার মুরাদনগর গাঙ্গেরকোট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে বেড়াতে আসেন তিনি। পারিবারিক জীবনে পল্লী চিকিৎসক বাবা এবং সৎ মায়ের সংসারে তিন বোনের টানাপোড়নের জীবন। ক্লাসের মেধাবী ছাত্রী মোমেনা শহরে এসে পার্শ্ববর্তী এক মহিলার কাছে চাকুরীর কথা শুনে লুফে নেন এবং ইয়াংওয়ান গ্রæপের একটি গার্মেন্টসে কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর পদে যোগদান করেন।
২০০৩ সালে ইয়াংওয়ানেরই এক কর্মকর্তার সাথে তার বিয়ে হয়। চাকুরী, সংসার নির্বাহ করে তিনি নিজ গ্রামের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেও কৃতকার্য হতে পারেননি। ২০০৪ সালে তার প্রথম ছেলের জন্ম হয়। সুনামের সাথে চাকুরির সুবাদে পরবর্তীতে সুপারভাইজার পদে পদোন্নতি সত্তে¡ও পরিবারের কাছাকাছি কোন আত্মীয়স্বজন না থাকাতে বাচ্চা লালন-পালনে তিনি চাকুরি ছাড়েন। চাকুরি ছাড়ার পর ২০০৪ সালে কাজপাগল মোমেনা ভাবতে থাকেন নিজ উদ্যোগে কিছু করা যায় কিনা। তখন তারা চট্টগ্রাম শহরের ক্রসিং, এমপিবি গেইট এলাকায় ভাড়াবাসায় থাকতেন। মোমেনা লক্ষ্য করেন বাসার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাচ্চাদের একটি বিখ্যাত স্কুল-গেইটে প্রতিদিন শত শত ‘মা’ জড়ো হন। তার মাথায় ভাবনা আসে এখানে কোন ব্যবসা করা যায় কিনা। ব্যবসার লক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে তিনি স্কুল-গেইটে অপেক্ষমান মা’দেরই স্থির করলেন। তিনি আরো স্থির করলেন জড়ো হওয়া নারীদের এমন কিছু বিক্রি করতে হবে-যা তারা তার কাছে পেয়ে খুশি হন।
তিনি ভাবলেন নারীদের এমন কিছু আইটেম রয়েছে যেগুলো তারা অন্যকে দিয়ে কেনাতে পারে না, আবার অনেক সময় ব্যস্ততা বা পছন্দসই না হওয়ায় স্বামীকে দিয়ে কিনাতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এরকম কিছু আইটেম; মহিলাদের ইনার গার্মেন্টস, বেবি আইটেম নিয়ে মোমেনা আশপাশ এলাকায় কিছু কিছু পণ্য বেচাকেনা শুরু করেন। ২০০৫ সালে ঘাসফুল পতেঙ্গা শাখার তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক নুরুজ্জামান মোমেনার ব্যবসায়িক উদ্যোগের কথা শুনে তাকে প্রথমে পনের হাজার টাকা ঋণের ব্যবস্থা করেন। ঋণ পেয়ে মোমেনা টেরিবাজার পাইকারি দোকান থেকে কোয়ালিটি সম্পন্ন নারীদের ইনার গার্মেন্টস পণ্যসামগ্রী, নানারকম বেবি আইটেমসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য এনে স্কুল-গেইটে অপেক্ষামান মা’দের কাছে বিক্রি শুরু করেন। তার স্বভাবসুলভ সারল্য আর সততা দিয়ে স্কুল-গেইটে অপেক্ষামান ‘মা’ এবং নেভি কলোনির স্থানীয় নারীদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
এলাকায় মোমেনার পরিচিতি বাড়ার সাথে বেচাবিক্রিও বাড়তে থাকে। ঘাসফুল পরবর্তীতে তাঁকে পাঁচ দফায় আট লাখ টাকা ঋণ প্রদান করে। ঘাসফুলের ঋণ এবং অন্যান্য সহায়তা নিয়ে মোমেনা বাড়াতে থাকে তার পুঁজি এবং বিনিয়োগ। মোমেনার বড় ছেলে আকিব ২০০৮ সালে নৌবাহিনী স্কুলে ভর্তি হলে তার ব্যবসায়িক ধারণায় নতুন মোড় নেয়। তিনি ২০০৯ সালে স্কুল-গেইটের কাছেই ‘এম.টি. ফ্যাশন’ নামে একটি শো-রুম নেন, যেটি এখন ভাবির দোকান নামে এলাকায় খ্যাতি পায়। ক্রেতাদের আন্তরিকতা আর ব্যবসায়িক সুনাম তাকে ব্যবসার নতুন পরিকল্পনায় দারুণভাবে উৎসাহিত করে। মানুষের আন্তরিকতায় মুগ্ধ মোমেনার কাছে ব্যবসা তখন শুধুমাত্র আয়-রোজগারের পথ নয়, বরং এক ধরণের সামাজিক বন্ধন হিসেবে নেশা জাগায়। মোমেনার জীবনে পেশা এবং নেশা যেন একসূত্রে বাঁধা পড়ে। এভাবে কিছু দিন চলার পর মোমেনা তার পূর্ববর্তী চাকুরীর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দোকানে একটি সেলাইমেশিন বসিয়ে নিজেই কিছু কিছু উৎপাদন শুরু করেন।
নারায়ণগঞ্জ থেকে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি সম্পন্ন কাপড় ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে নিজস্ব ডিজাইন এবং ‘এম.টি.ফ্যাশন’ ব্র্যান্ডে মহিলাদের বিভিন্ন ধরণের ইনার গার্মেন্টস আইটেম, কাপড়ের ব্যাগ এবং মেয়ে বাচ্চাদের জামা তৈরি করতে থাকেন। এসব উৎপাদিত পণ্য নিজের শো-রুম ছাড়াও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন এলাকায়, শপিংমলে বাজারজাত করার ব্যবস্থা নেন। এভাবে চাহিদা বাড়াতে ধীরে ধীরে তিনি সেলাইমেশিন ও কর্মীও বাড়াতে থাকেন। পণ্য বাজারজাতকরণে এর মধ্যে তিনি নিজস্ব উদ্ভাবনী পন্থায় ভিন্ন ধরণের এক মার্কেটিং নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেন। স্বল্প আয়ের পরিবারের নারী, স্বল্পবেতনের গার্মেন্টসকর্মী, নারী হকার, এমনকি ভবঘুরে ভিক্ষুক মহিলাদের পর্যন্ত তিনি তার মার্কেটিং নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসেন। নেটওয়ার্কের আওতায় এসব মহিলারা মোমেনার উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন এলাকা কিংবা মার্কেটে নিয়ে যান এবং মাসশেষে অবিক্রিত পণ্য ও বকেয়া ফেরত দিয়ে প্রায় প্রতিজনই ২/৩ হাজার টাকা করে রোজগার করতে থাকেন।
মোমেনার ভাষ্যমতে তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আয়-রোজগারের পথ শিখিয়ে তার মতো অন্য নারীদেরও পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন মাত্র। এভাবে তিনি ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন এবং বর্ধিত আয়-রোজগার দিয়ে শহরের পতেঙ্গা থানার খেজুরতলা এলাকায় একখন্ড জমি কিনে বাড়ি করেন। একসময় ব্যবসার পরিধি বেড়ে যাওয়ায় তিনি স্বামীকে চাকুরি ছাড়িয়ে নিজেদের ব্যবসায় নিয়ে আসেন। বর্তমানে তার স্বামীরও আলাদা শোরুম ও সাপ্লাই ব্যবসা রয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে মোমেনার স্বপ্ন, সংগ্রামী পথ বেয়ে ঘুচাতে থাকে দুঃখ। মোমেনার ছোটবেলায় বাবার সাথে তাদের মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ায় মাতৃহীনা তিনবোন সৎমায়ের সংসারে বড় হন। তাদের জীবনে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় ছিলো মায়ের কোন স্মৃতিই তাদের ছিলো না। এমনকি বড় হয়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে পর্যন্ত জন্মদাত্রী মায়ের নাম নেই, আছে সৎমায়ের নাম। পরবর্তীতে মোমেনা এবং তার স্বামী কাজী সাইফুল ইসলামের নিরন্তর প্রচেষ্টায় ছোটবেলায় ছেড়ে যাওয়া মায়ের সন্ধান করে খুঁজে পান।
২০০৯ সালে তাদের কোল আলো করে আসে কন্যাসন্তান। শুধু নিজের পরিবার কিংবা নিজের জীবন নয়, মোমেনা দায়িত্ব নেন তার বাকি দুইবোনেরও। বড়বোনের স্বামীকে শহরে বাড়ি করে দেন এবং ছোট বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ব্যবসার অগ্রগতিতে মোমেনা যথাসময়ে যথার্থ উদ্যোগ নিতে ভুল করেননি। তিনি ২০১৫ সালে শো-রুমের কাছাকাছি ছোট্ট একটি কারখানা চালু করেন। পুরোদমে কারখানা চালু করার পর মোমেনাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার কারখানায় রয়েছে ৬/৭টি অটো সেলাইমেশিন, চারজন দক্ষ কারিগর, দুইটি শোরুম এবং দুইজন নারীকর্মী। বর্তমানে তিনি স্থানীয় বাজার ছাড়াও শহরের বিভিন্ন শপিংমলেও পণ্য সরবরাহ করছেন। মোমেনার কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান ভালো এবং বিক্রয়মূল্য তুলনামূলক কম হওয়ায় তাকে মার্কেটে যেতে হয় না বরং ছোটবড় বিভিন্ন ধরণের ব্যবসায়ি নিজেরা এসে তার উৎপাদিত পণ্য নিয়ে যায়।
মোমেনা জানান, প্রতিমাসে তার বিক্রয় হয় ৭/৮ লাখ টাকা। কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে প্রতিমাসে তার ৩/৪ লাখ টাকা আয় থাকে। মোমেনা বেগম বর্তমানে চট্টগ্রাম ওমেন চেম্বার এন্ড কমার্স এর সদস্যপদও লাভ করেন। মোমেনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে বলেন, ‘বাংলাদেশের বাজারে আমি এমন গুণগত মানসম্পন্ন ইনার গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদন করতে চাই, যাতে বাংলাদেশের নারীরা বিদেশী পণ্য ব্যবহার না করে স্বেচ্ছায় এবং সন্তুষ্টি নিয়ে দেশিয় পণ্য ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন।’ মোমেনার এই উদ্যোগের পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি স্কুলগেইটে অলস সময় কাটানো বাচ্চাদের জন্য অপেক্ষারত মা’দের নিয়ে ভেবেছেন এবং তিনি শুধু তাদের ক্রেতা বানাননি বরং এদের মধ্যে অনেককে আয়-রোজগারের পথও দেখিয়েছেন। দ্বিতীয়ত তিনি শুধু পণ্য বাণিজ্য করে থেমে যাননি বরং নিজে কারখানা স্থাপন করে দেশের মানুষের জন্য গুণগত পণ্য নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তৃতীয়ত; তিনি একজন ব্যক্তির সংগ্রামী জীবনের মাধ্যমে অপর দুইবোনের সংসার এবং নিজ সংসারে সচ্ছলতার পথ খুঁজে দিয়েছেন।
সমাজের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে কাটানো ব্যক্তি মোমেনার শৈশব, বেড়ে উঠা এবং উত্থানপর্ব পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনি শুধু আয়-রোজগারের পথ খুঁজে বেড়াননি, চলার পথে মানবিকতার স্বাক্ষরও রেখেছেন স্পষ্টভাবে। স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপকালে জানা যায়, তিনি ওই এলাকার বিভিন্ন সামাজিক জনহিতকর কর্মকান্ডেও জড়িত রয়েছেন। ব্যবসা ক্ষেত্রেও তার সৃষ্ট বিপনন প্রক্রিয়াটি ছিল অভিনব এবং জনহিতকর। আমরা যখন মোমেনার শো-রুমে পৌঁছায় তখন প্রায় দুপুর। আমাদের সাথে সাক্ষাতকারে বসে তিনি শো-রুমের কর্মচারিদের বলেন, ‘মা’ তোমরা খেয়ে এসো, তোমরা আসলে আমি যাবো খেতে!’ হাসিমুখে এক এক করে জড়তাহীন কন্ঠে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাননি মোমেনা। জীবনযোদ্ধা মোমেনা বেগম অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে পারিবারিক জটিলতার মধ্য দিয়ে একাই জীবনের পথ খুঁজে নিয়েছেন। নানারকম পারিবারিক দ্বন্ধে, জীবন সংগ্রামে অপর তিনবোনসহ তার বেড়ে উঠা।
মোমেনার জাতীয় পরিচয়পত্রে আসল মায়ের নাম দেয়া হলো না কেন? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে কথা আটকে যায় তার মুখে! ছলছল চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, কিছুই বলতে পারেননি! এসএসসি পরীক্ষার পর ফলাফল বেরুবার তিনমাস সময়ে মোমেনা চট্টগ্রাম শহরে আসেন বেড়াতে। বেড়াতে এসে কেন চাকুরি খুঁজলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে মোমেনা জানালেন, বাবা আগ্রাবাদ হাজিপাড়ায় ডাঃ নুরুল আবছারের চেম্বারে কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করতেন। খুবই সামান্য বেতন। তারা তিনবোন ছাড়াও সৎ মায়ের ঘরে রয়েছে ছেলে সন্তান। পরিবারে সবসময় লেগে থাকতো অভাব-অনটন আর অসচ্ছলতা।’ মোমেনা আরো বলেন, ‘স্কুলের প্রতিটি ক্লাসে মেধাবী ছাত্রী হিসেবে ফলাফল থাকলেও পরিবারের হাল ধরতে ইয়াংওয়ানে কাজ নিই। মনে মনে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার যে স্বপ্ন ছিল তা আমি আমার ছেলেমেয়ের মাধ্যমে পূর্ণ করতে চাই!’
বর্তমানে তার বড় ছেলে অস্টম শ্রেণিতে এবং মেয়েটি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের আলাদা ব্যবসা, আলাদা প্রতিষ্ঠান। মোমেনা আরো জানান, তার পুরো ব্যবসায়িক জীবনে একদিনও অনুপস্থিতি নেই, প্রতিদিনই তিনি ভোরে এসে শো-রুম খুলেন এবং রাত ৮/৯ টায় বাসায় ফিরেন। বাসায় ফিরে অন্যান্য মায়ের মতোই তিনি বাচ্চাদের দেখাশুনা এবং রান্না-বান্নার কাজ সেরে নেন। তিনি বলেন, ‘জীবনে আনন্দ আছে, অর্জন আছে, ক্লান্তিও আছে তবে বিশ্রামের অবসর নেই!’ তিনি তার কাজটাকে উপভোগ করেন, এরকম আনন্দ আর অর্জনে পার করতে চান বাকিটা জীবন। আমরাও চাই, সফল সংগ্রামি নারী মোমেনা বেগমের স্বপ্ন সফল হোক, অসম্পন্ন ইচ্ছেগুলো পূর্ণ হোক, ভালোবাসায় ভরে উঠুক তার পরিবার, সম্মান ও স্বীকৃতিতে অগ্রযাত্রার প্রতীক হয়ে উঠুক সমাজে।