গ্রামীণ ঐতিহ্য বহন করে নকশি পিঠা
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
দৈনন্দিন শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের কিছু খাবারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এর বাইরেও মানসিক তৃপ্তি বা আত্মার তৃপ্তির জন্য আমরা কিছু খাবার খেয়ে থাকি। সে সকল খাবারে হয়তো আমাদের পেট ভরেনা কিন্তু মন ভরে। গ্রামীণ পরিসরে সহজলভ্য, প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে এসব খাবার। এগুলোর মধ্যে নকশি পিঠা অন্যতম। লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের একজন নারী দিলরুবা আক্তার। তিনি সংসারের যাবতীয় কাজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের জন্য বিভিন্ন ধরণের নকশি পিঠা তৈরী করেন।
নকশি পিঠা তৈরীর প্রধান উপকরণ হলো আতপ চালের গুঁড়া। পাশাপাশি আরো প্রয়োজন হয় মাটির হাঁড়ি, কাঁঠাল পাতা বা কলা পাতা ও বাঁশের চালনি। চালের গুঁড়াকে প্রথমে পানি মিশিয়ে মেখে নিতে হয়। পানি এমনভাবে মিশাতে হবে যেন মিশ্রণটি আঠালো অবস্থায় থাকে। এই পিঠায় রঙের বৈচিত্র্য আনতে হলুদের গুঁড়া, জর্দা তৈরির রঙ ইত্যাদিও মেশানো যায়। রঙ মেশানো হয়ে গেলে কাঁঠাল বা কলা পাতায় তেল মাখিয়ে নিতে হয়। এরপর চালের গুঁড়ার মণ্ডটি অল্প অল্প করে ইনজেক্শনের সিরিঞ্জে ভরে তেল মাখানো পাতার উপর বিভিন্ন নকশায় ছড়িয়ে দিতে হয়।
ফুল, পাখি, গাছ, লতাপাতা ইত্যাদি নকশা করে এই পিঠা তৈরি করতে হয়। এরপর মাটির হাঁড়িটিতে পানি দিয়ে চুলায় বসিয়ে, হাঁড়ির মুখে চালনিটি রেখে দিতে হয়। আগুনের তাপে পানি যখন ফুটে উঠে তখন নকশা করে রাখা পিঠার পাতাগুলো চালনির উপর রেখে ঢেকে দিতে হয়। পিঠাগুলো ভাপে সিদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে, পাতা থেকে ছাড়িয়ে রোদে শুকাতে হয়।
কয়েকদিনের রোদে ভালো করে শুকিয়ে নিলে পিঠাগুলো খাওয়ার উপযুক্ত হয়। তবে এভাবে খাওয়া যায় না। শুকনো পিঠাগুলোকে তেলে ভাজতে হয়। এরপর এর উপর চিনি ছড়িয়ে দিলেই খাওয়া যাবে।
এক কেজি আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে প্রায় ৮০ টির মতো পিঠা তৈরি করতে পারেন দিলরুবা। রোদে শুকানো পিঠাগুলো অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে ঝটপট তেলে ভেজে পরিবেশন করেন তিনি। তাছাড়া গ্রামে বা আত্মীয়দের বাড়িতে কারো বিয়ে হলে নতুন বরের নাশতা হিসেবেও এই পিঠা তিনি উপহার দিয়ে থাকেন।
দিলরুবা তাঁর নানীর কাছ থেকে এই নকশি পিঠা তৈরি করতে শিখেছিলেন। কিশোরী বয়সে শেখা এই নকশি পিঠা তিনি একসময় বাড়ির চাচাতো বোন ও প্রতিবেশি বোনদের নিয়ে তৈরি করতেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে এই পরিবারের অনেককেই শিখিয়েছেন। এখনো গ্রামের আগ্রহী কিশোরীরা তাঁর কাছে আসে এই পিঠা তৈরি করা শিখতে। তিনি তাদের যতœ নিয়ে পিঠা তৈরি করা শিখিয়ে দেন।
এই পিঠা একা তৈরি করার চাইতে অনেকে মিলে তৈরি করার আনন্দটা ভিন্ন রকমের। তাছাড়া প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন নকশায় পিঠা তৈরি করেন বলে দেখতেও ভিন্নতা আসে।
পিঠা তৈরির সাথে জড়িয়ে আছে এদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর এক অনবদ্য জীবনাচার। মনের মাধুরী মিশিয়ে, আন্তরিকতার রঙে সাজিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন নকশি পিঠা। গৃহস্থ ঘরের সাধারণ নারী ; যাদের শিল্পি হিসেবে আলাদা কোনো পরিচয় নেই, তাঁরাই এই পিঠা তৈরির কারিগর। বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুন বর বা আত্মীয়স্বজন আপ্যায়নে আধুনিক সব উপকরণ ছাপিয়ে আজও জায়গা দখল করে আছে আমাদের গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি নকশি পিঠা। স্বল্পস্থায়ী এসব খাদ্যবস্তু তৈরিতে গ্রামীণ নারীদের সৌন্দর্য্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তাছাড়া অতি সাধারণ ও স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণ দিয়ে তৈরি এ ধরণের খাদ্যদ্রব্য আমাদের সংস্কৃতিরও পরিচয় বহন করে।