সুন্দরবন নির্ভরশীল বনজীবীদের সংস্কৃতি ও বিশ্বাসে বনবিবি

সাতক্ষীরা থেকে পীযূষ বাউলিয়া পিন্টু ও বাবলু জোয়ারদার

সুন্দরবন উপকূল এলাকাজুড়ে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল বনজীবীরা জীবন-জীবিকায়, নিরাপত্তায় এবং লক্ষ্য ও বিশ্বাসে বনবিবি পূজা করে থাকেন। সুন্দরবনের পেশায় জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল বনজীবীরা বনের রক্ষাকর্তা হিসেবে বনবিবি পূজা তাদের বিশ্বাসের প্রাণবিন্দু। লোক কাহিনীতে বনবিবির ইতিহাসের কথা জানা যায়।
এতদ্বকালে সুন্দরবনে সেসময় দ্বন্ডবক্ষ নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রজাবৎসল্য সব্যসাচী। তাঁর স্ত্রী রায়মনি। তাদের যথেষ্ট আধিপত্য ছিল। প্রজাকুলের দেখভাল করতেন। কথিত আছে, জঙ্গলে যত দানব দৈত্য ভূতপ্রেত ডাকিনি যোগিনী সব তার অনুগত্য ছিল। তার ছিল ৩৭ কোটি সিপাহি লসকার। সমুদ্র সৈকতে কোনো একখানে ছিল তার রাজধানী।


তাদের ছিল একটি সন্তান নাম দক্ষিণা রায়। সে দিনে দিনে দস্তর পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে। তপস্যা বলে বাঘমূর্তি ধারণ করে মানুষ ধরে খেত। মানুষ ভীতি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। কেউ আর বাদাবনে মধু সংগ্রহ করতে যেতে পারে না। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকলো বনজীবিরা। পরম করুণাময় খোদাতালা দুষ্টের দমনের জন্য বনবিবি ও শাহ জঙ্গলিকে দুনিয়ায় পয়দা করলেন। ১৮ ভাটিতে যাওয়ার জন্য হুকুম করলেন।


বনবিবির পিতৃ পরিচয়ে তৎকালীন মক্কর ধর্মভিরু দরিদ্র ইব্রাহিম ফকিরের দ্বিতীয় স্ত্রী গুলাল বিবির গর্ভে বনবিবি ও শা-জঙ্গলী নামে জমজ ভাই বোনের তাদের মা বনবাসে থাকাকালীন সুন্দরবনের মধ্যে জন্ম হয়। উল্লেখ্য, ইব্রাহিম ফকির তার ১ম স্ত্রী ফুলবিবির সঙ্গে ওয়াদা রক্ষার্থে তার কথামতো পূণ্য মাসে নিষ্ঠুরভাবে গুলাল বিবিকে বনবাসে পাঠান। পরম করুণাময় রাব্বুল আলামীনের অশেষ কৃপায় জঙ্গলে দুই ভাই বোন ফলমূল হরিণ দুগ্ধ পানে বড় হতে থাকেন।


এক পর্যায়ে দুই ভাই বোন মা ও বাবা ইব্রাহিম ফকিরের সঙ্গে জঙ্গলে তাদের মিলন ঘটে। তারা বাবা মায়ের কান্নাকাটি উপেক্ষা করে দুই ভাই বোন আল্লাহর ডাকে মদিনাতে চলে যান। ওখানে নবীজির আওলাদ এক কামেল সাহেবের কাছে মুরিদ হন। মারফত কালাম বিদ্যায় তালিমও নিল। খোদার দরবারে দুই ভাই বোন মোনাজাত করলো। আল্লাহ পাক সন্তুষ্টিতে তাদের উপর ওহী নাযিল হলো। তোমাদেরকে খেলাফত দান করা হলো। ১৮ ভাটিতে চলে যাও। আল্লাহ পাক সব সময় তোমাদের সঙ্গে থাকবে। ওখানে ১৮ হাজার জাত (জীব) পয়দা আছে। তুমি যে ১৮ ভাটিতে সবার মা। বিপদে পড়েছে তোমাকে মা বলে ডাক দিবে তাদের উদ্ধার করবে। সেই থেকে বনবিবি বনের দেবতা, মা বলেই জানেন সবাই। বন বিবির পুথীর ইতিহাসে বলা হয়েছে মায়ের প্রথম পূজা ও তার কীর্তি থেকে বনবিবি ও শা-জঙ্গলী মদিনা থেকে অনেক কষ্ট সহে ভাটির অঞ্চল ১৮ ভাটিতে পৌঁছায় এবং ভুরকুন্ডে তার শিকড় গাড়েন।


বর্তমানে সেখানে ছিল সেই দুষ্টু শাসক দক্ষিণা রায়। কিছু দিনের মধ্যে কয়েক ভাটি বনবিবির আধিপত্য স্বীকার করে কিন্তু প্রতাপশালী রাজা দক্ষিণা রায় বনবিবির আধিপত্য মেনে নিতে পারেননি। সে কারণে তিনি বনবিবির বিরুদ্ধে নিজের মাতা নারায়নিকে যুদ্ধে পাঠান। নারায়নি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সন্ধি স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, জঙ্গলে বাদাবনের প্রথম মৌয়াল ধুনাই মৌলে তার বহর নিয়ে জঙ্গলে যায় মধু ভাঙতে। মধু না পেয়ে এক সময় চতুর দক্ষিণা রায়ের সঙ্গে তার দলের পাচক ছোট ছেলে দুখেকে খেতে দিলে তার সপ্তবহর মোম মধু ভরিয়ে দেবে। ফন্দি করে চতুর্থ ধোনাই মৌলে দুখেকে কেঁদো খালি নামক স্থানে কাঠ কাটার জন্য তুলে দেয়।


দক্ষিণা রায় বাঘ রূপ ধারণ করে দুখেকে খেতে আসলে তার অশীতিপর বৃদ্ধ মায়ের আদেশ মত বনবিবিকে মা-মা বলে চিৎকার করতে থাকে। মা-সঙ্গে সঙ্গে মক্ষি রূপে ছুটে আসে। আক্রান্ত দুখেকে কোলে তুলে নিয়ে জলের ছিটে দিলে জ্ঞান ফিরে আসে। দুখেকে অনেক ধন দৌলত দিয়ে সেঁকো নামক কুমিরের পিঠে তুলে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেন। দুখেকে বাঘে খেয়েছে বলে ধোনাই মৌলের মিথ্যা প্ররোচণায় দুঃখের মা পাগল বেশে ঘুরতে থাকে। মা-বনবিবির অহি তুষ্টে দুখে বাড়িতে ফিরে দেখে মা অন্ধ পাগল বেশে ঘুরে বেড়ায় দ্বারে দ্বারে। মা-বনবিবির কথামতো দুখে নিজ হাতে মায়ের চোখে জল ছিটিয়ে দিলে সুস্থ হয়ে যায় তার মা। পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে পায় এবং দুখেকে চিনতে পারে, বাপ ধন বলে দুখেকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা।
দুখেকে পেয়ে তার বৃদ্ধ মা বনবিবি সন্তুষ্টির জন্য গলায় কুড়াল ঝুলিয়ে সাত সাতগ্রাম মাং (ভিক্ষা) চাল চিনি দুধ দিয়ে রান্না করে বনবিবির পূজায় দেওয়া হল।


চলমান ইতিহাসের সাথে উপকূলের সংস্কৃতি ও বিশ্বাসে শ্যামনগর উপকূল জনপথ সুন্দরবন নির্ভরশীল বনজীবীদের সংস্কৃতিতে বনবিবি পূজা পূর্বপুরুষ থেকে পালন করেছে। বন কেটে আবাদ করা জনবসতিতে সুন্দরবনের সংস্কৃতি ও বিশ্বাসে বনবিবি পূজা উপকূলের প্রতিটা বনজীবীদের জীবন সংস্কৃতিতে মিশে গেছে। এখানে নেই কোন ভেদাভেদ সকল ধর্মের মানুষের সুন্দরবনের সংস্কৃতিতে বনবিবি পূজা ধারণ করে আছে।
মুন্সিগঞ্জ জেলে পাড়ায় কৃষ্ণপদ মন্ডল (৭২)। তিনি বলেন, বাপ দাদার আমল থেকে আমরা সুন্দরবনের পেশার সাথে জড়িত, আমরা জেলে পরিবার আমরা সুন্দরবনের পেশা ছাড়া অন্য কোন পেশায় কাজ করতে পারেনি। আমাদের এখানে পূর্ব পুরুষ থেকে বন কেটে আবাদ করে বসতি গড়ে। আমরা আগে এখানে বনবিবির পূজা করতাম। গত ২০ বছর যাবৎ বনের মধ্যে কুলখালী নামক খালে মা বন বিবির প্রতিমা তুলে ক্ষীর রান্না করে পূজা দেই। এখানে শত শত বনজীবী পৌষ সংক্রান্তিতে পূজা দিতে আসেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া বনের মধ্যে বনবিবির মন্দির থাকার কারণে যে সকল বনজীবি বনে যান তারা ওখান থেকে মানত করে মাছ, কাঁকড়া ও মধু সংগ্রহ করে নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন এ বিশ্বাস অনন্তকালের বনজীবীদের।’


মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের জেলেখালিতে শতবর্ষী বনবিবি পূজা পালন করে আসছে বনজীবিরা। জনশ্মৃতিতে প্রায়তঃ নীলকান্ত ফকির ও যজ্ঞেশ্বর ফকির তারা প্রথমে বনবিবি পূজা শুরু করেন। আলাপচারিতায় ভূধর চন্দ্র বলেন, ‘এই বনবিবি পূজাটা স্বপ্নে পাওয়া। একসময় এই জনপদে বন কেটে আবাদ করা বসতির সাথে জীবন জীবিকা গড়ে ওঠে। আবাদ করার সময়ে পূর্ব-পুরুষ এবং জমিদারদের সময়ে ইতিহাস খ্যাত রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজত্ব এরিয়ায় আবাদ করার সময়ে বহু মানুষ বাঘে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। স্বপ্নে পাওয়া এই বনবিবি পূজা করে বনজীবীরা রক্ষা পায়।’
সুন্দরবন লাগোয়া মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের চুনকুড়ি মীরগাং গ্রামে পৌষ সংক্রান্তি ও পহেলা মাঘে বনবিবি পূজা পালন করে থাকেন। উপকূলের সুন্দরবন নির্ভরশীল বনজীবীদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে অনন্তকাল পালন করে যাবেন বনবিবির পূজা কথাটি জানালেন বনজীবী করুণা রানী।


শ্যামনগরের সুন্দরবন নির্ভরশীল জনপথ রমজাননগর ইউনিয়নের গোলাখালি, কালিঞ্চি ও নতুন ঘেরী এই তিনটি গ্রামে ৩টি স্থানে পৃথকভাবে বনবিবি পূজা পালন করে থাকে বনজীবিরা। কালিঞ্চি গ্রামের স্থানীয় বনজীবী গোপাল মুন্ডা বলেন, ‘আমাদের এখানে ৬৬ বছর ধরে বনবিবি পূজা করছে বনজীবিরা। সুন্দরবনের বিভিন্ন পেশায় বনজীবীরা ভুত, প্রেত, দানব, দৈত্য ও বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মা বনবিবির পূজা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এলাকার বনজীবীরা সেখান থেকেই আমাদের এখানে পূজা চলমান। এই পূজায় কোন বিধি নিষেধ নেই এবং ব্রাহ্মণ লাগে না। প্রবীণ বনজীবী বাওয়ালীরা শুধুমাত্র সুন্দরবনের ইতিহাস খ্যাত বনবিবির পুঁথি পড়তে পূজা দেওয়া হয়।’
যুগপৎ পরিবর্তনের ধারার মধ্যে হল সংস্কৃতি ও বিশ্বাসে সুন্দরবন নির্ভরশীল বনজীবীরা অদ্যবধি চলে আসছে মায়ের নামে পুঁথি পাঠ করে বন বিবি পূজা করা। যেহেতু বনবিবি ইসলাম ধর্মীয় অনুকরণীয় তাই তার পূজায় সকল শ্রেণীর মানুষসহ বনজীবীরা ক্ষীর রান্না করে মোরগ উড়িয়ে মানত নিবেদন করেন।
বনবিবি মা আছেন সুন্দর বনে, বিশ^াসে আছেন, সংস্কৃতিতে আছেন।

happy wheels 2

Comments