সুন্দরবনের ভাসান জ্বালানি ও প্রাকৃতিকভাবে বনসৃজন
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে রয়েছে শতাধিক প্রজাতির ফলগাছ আর রয়েছে ৩২০ প্রজাতির নানা ধরণের উদ্ভিদ। সুন্দরী, কেওড়া, বাইন, পশুর, কাঁকড়া, ধুন্দল, গোলপাতা, হরখোজা, গেওয়া, হোগলা, খলিশা, হেতাল, ওড়া, জানা, ধানীসহ নানান প্রজাতির উদ্ভিদ উল্লেখ্যযোগ্য। সুন্দরবনের বিশাল বনভুমির শতাধিক ফল বৃক্ষের হরেক রকম ফল নদীর পানিতে ভেসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ ফলগুলো ভাসতে ভাসতে নদীর কিনারায় আসার পর উপকূলীয় এলাকার মানুষরা এগুলো সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। সুন্দরবন থেকে বারো মাসই কোন না কোন ফল সংলগ্ন নদীর কিনারায় ভেসে আসে।
সুন্দরবনের ভাসমান ফলের তথ্য সংগ্রহের সময় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতায় শ্যামনগরের সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার মানুষ বনের ভিতর থেকে ভেসে আসা ফলগুলো জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করছেন। প্রতিদিন ভেসে আসা বিভিন্ন প্রজাতির শত শত ফল নারী পুরুষেরা সংগ্রহ করছেন। এই ফলগুলো রোদে শুকিয়ে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এখানকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ভেসে আসা ফলগুলোর শাঁস বাদ দিয়ে উপরের খোলস জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করেন।
সাতক্ষীরা শ্যামনগরের দাঁতিনাখালী গ্রামের শেফালী বেগম, সোনাভানু বেগম, সেলিনা খাতুন, সাজিদা আক্তার তালবাড়ীয়া গ্রামের, করুণা রাণী, শংকরী রাণী, সুনিতা রাণীসহ বেশ কয়েকজন নারী জানান, সুন্দরবন থেকে নানা ধরণের ফল তাঁদের নদীর কিনারে ভেসে আসে, তাঁরা ফলগুলো সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। মূলত ভিতরের অংশ ফেলে দিয়ে খোসাটা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করেন তবে বাইনের বীজটা আগুনে পোড়ে না বলে এটা নদীতে ফেলে দেন। তারা আরও জানান, ফল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের কারণে বাদার (বন) অনেক ক্ষতি হয়, কিন্তু কি করার আছে, জালানি কাঠের অভাবে বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের ফলকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে হয়।
সুন্দরবনের ফল প্রাকৃতির নিয়মে নির্ধারিত সময়ে পেকে গাছ থেকে মাটিতে পড়ে এবং গাছের তলায় অংকুরোদগমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। আবার অনেক বীজ জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে বনের অভ্যন্তরে মাটিতে আটকে চারা বের হয় এবং অধিকাংশ বীজ জোয়ারে ভেসে নদীর কিনারে বা চরে এসে জমা হয়। সেখানেই মাটিতে অঙ্কুরোদগম হয়। আবার কোনো কোনো প্রজাতি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গাছে থাকা অবস্থায় অঙ্কুরোদগম হয়ে নিচে পড়ে কাদামাটিতে আটকে গিয়ে শিকড় গজায় ও চারা তৈরি হয়। এভাবে এক সময় সম্পূর্ণ চরটি সবুজে ভরে ওঠে। বর্তমানে অনেক উদ্যোগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চর বনায়নের মাধ্যমে উক্ত চারা সংরক্ষণ করেন। এছাড়াও কোনো কোনো সংস্থা এসব চারার মাধ্যমে প্রতিবেশীয় বনায়ন কার্যক্রম করছেন।
মুন্সিগঞ্জ ফরেষ্ট ক্যাম্প এর অফিস ইনচার্জ মনিরুল ইসলাম সুন্দরবনের ভাসমান ফল সম্পর্কে বলেন, “প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবনের গাছ থেকে বিভিন্ন ফল নিচে পড়ে সুন্দরবনের মধ্যে কিছু চারা গজায় এবং অধিকাংশ ফল জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে নদীর কিনারে জমা হয়। এসব ফলগুলো গ্রামের নারীরা সংগ্রহ করে নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে একদিকে উপকূলীয় নারীদের সাময়িক জ্বালানি সমস্যার সমাধান হলেও পরিবেশের জন্য এর ক্ষতির পরিমাণ বেশি, কেননা এসব ফল থেকে প্রাকৃতিকভাবে অনেক বনায়ন গড়ে উঠত”।
সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা ফলগুলো সংরক্ষণ করা গেলে নদীর চরগুলো হরেক রকমের গাছে ভরে যেত, তৈরি হত সবুজ বেষ্টনী, ফুটে উঠতো সুন্দরবনের মনোরম দৃশ্য। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, নদীভাঙন রোধ, জ্বালানি সংকট নিরসন, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সবুজ বেষ্টনী তৈরি তথা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় নদীর চরে ভেসে আসা ফলগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।