আমরা নারী আমরা সব পারি

মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে শিমুল বিশ্বাস

নিজের জীবন কাহিনী বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন গাড়াদিয়া গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী নারী মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, তখন আমার মা জোড় করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমি প্রতিবাদ করি। তখন বিয়ে বন্ধ করতে পারলেও ১০ম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাধ্য হয়ে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় আমাকে। স্বামী ছিল রাজাকার। জানতাম না। যে কারণে বিয়ের দিন বিকালেই তিনি গ্রেফতার হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আবার পড়া লেখা শুরু করি। ১৯৭৪ সালে আমি এসএসসি পাশ করি। আমার আবার বিয়ে হয়। এবারও আমার ভাগ্য সহায় ছিল না। আমার নিজ গ্রামের একটি ছেলের সাথে বিয়ে হলেও আমি আমার বিবাহিত জীবনের একটি দিনও শান্তিতে কাটাতে পারিনি। স্বামী কোন ধরনের খোজ খবর নিতো না। বাধ্য হয়ে দুই মেয়ে এবং দুই ছেলেকে মানুষ করতে অনেক কষ্ট করেছি। এরপর নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রশিকার সাথে জড়িত হই। আমার নেতৃত্ব বিকশিত হতে থাকে। প্রশিকায় থাকাকালিন আমি বায়রা ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের জনপ্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হই। শুরু হয় জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য চেয়ারম্যানের সাথে সংগ্রাম। সারাজীবন সংগ্রাম করে এখন আমি প্রতিষ্ঠিত। তাই সকলের উদ্দেশ্য বলতে চাই ‘আমরা নারী আমরা সব পারি।’ শুধু এর জন্য প্রয়োজন আত্ম মনোবল ও সাহসী ভূমিকা।’

IMG_20191015_121646
‘টেকসই অবকাঠামো, সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রামীণ নারী ও কিশোরীর জেন্ডার সমতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হোক’-এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলা নারী উন্নয়ন কমিটি ও বারসিক’র যৌথ উদ্যোগে গতকাল পালিত হয়েছে বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা, র‌্যালি ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সিংগাইর উপজেলা নারী উন্নয়ন কমিটির আহব্বায়ক সেলিনা বেগমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সিংগাইর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমিন আক্তার, বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বায়রা ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের সদস্য ঝর্ণা খানম, সেলিনা আক্তার, নাছরিন আক্তারসহ নারী উন্নয়ন কমিটির সদস্যবৃন্দ ও বারসিক কর্মকর্তাবৃন্দ।

IMG_20191015_133714
অনুষ্ঠানের শুরুতে সকলের কন্ঠে ধ্বনিত হয় ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’ জাগরণী গান। এরপর নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ধরনের তথ্যচিত্রের উপর ভিডিও ডকুমেন্টরি প্রদর্শীত হয়। আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শারমিন আক্তার বলেন, ‘বর্তমান সরকার নারীবান্ধব। সুতরাং বাংলাদেশে নারীরা আর পিছিয়ে থাকবে না। একজন নারী শিশু সুযোগ পেলে হতে পারে সচিব, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা তাকে পঙ্গু করে ফেলে। অকালে ঝরে যায় তার স্বপ্ন। যে কারণে বাল্য বিয়েকে না বলতে হবে। আর সে জন্য আগে প্রয়োজন আমাদের সকলের বিবেক বোধ জাগ্রত করা। তাছাড়া বর্তমান তরুণ প্রজন্ম নেশার কারণে ধ্বংস হতে চলেছে। তাই তাদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিবারিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। তাহলে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি হওয়া সহিংসতা অনেকটা কমবে।’

IMG_20191015_122833
সেলিনা বেগম বলেন, ‘একজন নারী হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য আমাদের দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। তাহলে না হলে নারী হিসাবে আমরা পরিবার এবং সমাজে কোন প্রতিষ্ঠাই পাবো না।’ বায়রা কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সভাপতি সেলিনা বেগম বলেন, ‘আমাগো কন্যা শিশুগো লেখাপড়ার সুযোগ করে দিউন লাগবো। তাকে দক্ষ করতে অইবো। তাইলে (তাহলে) সে নিজের বাড়ি এবং শশুর বাড়িতে মর্যাদার সাথে বাস করবার পারবো। তাছাড়া নারী হিসাবে আমাগো স্কুল কমিটি, ইউনিয়ন পরিষদ, গ্রাম কমিটিসহ বিভিন্ন ধরনের কমিটিতে যুক্ত থাকুন লাগবো, যাতে আমরা আমাগো সমস্যার কথা কইবার পারি।’

আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তারা বলেন, ‘নারী উন্নয়নে তথা নারীর ক্ষমতায়নে যে সব প্রতিবন্ধকতা আছে নারী হিসাবে সেগুলো আগে জানা দরকার। তাহলে উক্ত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া নারী নির্যাতন, বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও নারীর অগ্রতিতে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলতে হবে। তাহলেই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।’

IMG_20191015_133736
আলোচনা শেষে নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিরাপত্তা, পারিবারিক আয়ে নারীর অধিকার ভিত্তিক ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ, গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়নে ভূমি ও কৃষি অধিকার নিশ্চিতকরণ, ঘরে ও বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ সকল ধরনের যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তির দাবিতে র‌্যালি ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

happy wheels 2

Comments