সাম্প্রতিক পোস্ট

হারিয়ে যাচ্ছে বেত

ঘিওর, মানিকগঞ্জ থেকে সুবীর কুমার সরকার
আমাদের ঐতিহ্য আমাদেরকে রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ একসময় কুটির শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। বাংলাদেশের জলবায়ু এদেশের মানুষের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। এদেশের অনেক মানুষ জীবনধারণ করেন প্রকৃতি প্রদত্ত উপাদানের ওপর। প্রকৃতির অন্যতম হচ্ছে বেত। বেত উপাদানের ওপর অনেক মানুষ নির্ভরশীল। গ্রামাঞ্চলে এখনো প্রবীণ ব্যক্তি আছে যারা বেত দিয়ে বিভিন্ন রকমের জিনিসপত্র তৈরি করতে পারে। বেত উপাদানের সঙ্গে আমাদের কুটির শিল্পের সম্পর্ক খুব বেশি। তাই বলতে পারি বেতশিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্যময় কুটির শিল্প। গৃহস্থালিতে বেতের ব্যবহার বহুবিধ। গৃহ নির্মাণে যেমন বেতের প্রয়োজন, তেমনি শৌখিন সজ্জাতেও বেতের কদর রয়েছে। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকা আছে যেখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য বেতের আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি রোজগারের একটি ভালো উপায় হিসেবে বিবেচিত। বেতের পাশাপাশি বাঁশশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকশিল্প। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ধামা-কাঠা সের, পালা, ফুলদানি, চেয়ার, দোলনা, বসার মোড়া, নিত্যব্যবহার্য এই বাঁশ এবং বেত সময়ের বিবর্তনে লোকসংস্কৃতি ও কারুশিল্পর প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠে।


যারা শহুরে হাওয়ায় বেড়ে উঠছেন তাদের অনেকে এই শিল্পগুলোর সঙ্গে খুব পরিচিত নয়। কুটির শিল্পের অন্যতম উপাদান বেত বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য বনজ সম্পদ। অতীতে গ্রামাঞ্চলে অনেকে বসতভিটার আশপাশে, রাস্তার ধারে, পতিত ভিটায়, পুকুর ধারে বেতের বাগ তৈরি করতো। বর্তমানে পতিত জায়গা ও পতিত ভিটা কমে যাওয়ার কারণে বেতের বাগ তৈরি কম হচ্ছে। আসবাবপত্র তৈরি ও অন্যান্য কুটির শিল্পে বেত ব্যবহার হয়। তরুণ প্রজন্ম জেনে খুশি হবেন একটা সময় ছিল যখন বাংলা থেকে বেত রফতানি হতো। বেত একজাতীয় লতানো বা বেয়ে ওঠা গাছ। বেতগাছ সাধারণত হিজুল, গাব, বৈন্ন্যা, কটা কড়ই, চিটকি, তেতুঁল, ডংক্কুগাছের সাথে বেয়ে উঠে। গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের অধিকাংশ জাগায় বেত জন্মে। বেত গাছে ছোট ছোট এক ধরনের ফল পাওয়া যায় যার নাম বেতুল ফল। অতীতে ছোট বয়সের শিশুরা এই ফলগুলো খেয়ে থাকতো। যার স্মৃতি এখনও মøান হয়নি।
সাধারণত দুই তিন বছর বয়সের ভালো আকৃতির বেত উন্নতমানের কাজে ব্যবহৃত হয়। মাঝারি পাকা বেতের মধ্যে জলীয় পদার্থ কম ও কাজ করার সময় আঠালোভাব বেশি থাকে। বেশি পাকা বেত কাজ করার সময় ভেঙে যায়। বেতকে প্রক্রিয়াজাত করা না হলে অল্পদিনেই তা বিবর্ণ হয়ে যায়। বাংলাদেশের লোকজীবনের খুব কম দিকই আছে যেখানে বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহৃত হয় না। শহরের বিভিন্ন সচেতন মানুষের বাসায় বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, ফুলদানি, প্রসাধনী বাক্স, ছবির ফ্রেম, আয়নার ফ্রেম, কলম দানি। পান রাখার ঝুড়ি এবং পাহাড়ের আদিবাসীদের দৈনন্দিন কাজে বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি পাত্রসমূহ খুবই আকর্ষণীয়। এসব পাত্র বা ঝুড়িতে বুননের মাধ্যমে নানা ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে তার মধ্যে বাঁশ এবং বেত অন্যতম।


বাঁশ ও বেতের সামগ্রী থেকে প্লাস্টিক সামগ্রী কেনার প্রতি এখন আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। আগে যেভাবে বাঁশ ও বেতের উৎপাদন হতো এখন তার চেয়ে অনেক কমে গেছে। কমে যাওয়ায় এর দামও বেড়ে গেছে। কিছু সৌখিন মানুষের ঘরে বাঙালির ঐতিহ্য প্রদর্শনের জন্য বাঁশ-বেতের সামগ্রী দেখা গেলেও অনেক ব্যবহারকারী বেশি দাম দিয়ে কিনতে চায় না। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাঁশ ও বেতের জিনিস বানাতে চায় না। তারা অন্য পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে। বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ ও বেতের সামগ্রীকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর পেছনের মানুষগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। অন্যথায় বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্প একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচাতে আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত। এই শিল্প আমাদের আদিকালের ঐতিহ্য। বেত শিল্পকে টিকিয়ে রাখা আমাদের সবার উচিত।


বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ছুটছে। তবে শত অভাব অনটনের মধ্যেও হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার আজও পৈতৃক এই পেশাটি ধরে রেখেছে। সরকারের সহায়তা পেলে এই লোকজ শিল্পগুলোর আবার সমৃদ্ধি আসবে। সরকারের এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা হোক।

happy wheels 2

Comments