আন্তর্জাতিক নারী দিবস: সুরক্ষিত হোক সকল নারীর অধিকার
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান
পৃথিবীতে বসতি শুরু হয়েছিল নারী-পুরষের যৌথ প্রচেষ্টায়। সভ্যতার শুরুতেই নারী-পুরষের লিঙ্গভিত্তিক তফাৎ তৈরি হয়নি। মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার বোধটিই ছিল প্রধান। কিন্তু সময় এক রকম থাকেনি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সমাজে টিকে থাকতে হচ্ছে নারীদের। নারী ছিটকে পড়েছে মানুষ নামের বিশেষণ থেকে। শুরু হয়েছে পুরুষের একতরফা কর্তৃত্ব। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। তা সত্বেও পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা বরাবরই থেকে যায় অবহেলিত। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশে নারীদের বিভিন্ন ধর্মীয় গোঁডামি, সামাজিক কুসংস্কার ও বৈষম্যের বেড়াজালে বন্দী করে রাখার প্রবণতা রয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। তবুও আমাদের মতো দরিদ্র দেশে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
একটু নজর দিলেই দেখা যাবে যে, আমাদের দেশে মেয়েরা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। শিক্ষার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও নারীরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সংখ্যায় এগিয়ে আসছেন। পারিবারিক ও সামাজিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে নারীরা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। এতসব সত্ত্বেও এখনও এদেশের নারীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেক উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও প্রবল পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল থেকে তারা মুক্ত হতে পারছেন না। নারীর অধিকার তাদের কাছে থেকে যাচ্ছে ব্র্যাকেটবন্দী। তাছাড়া দেশের সামগ্রিক অর্থনিীতিতে নারীর রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তার একটি বিরাট ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ। কিন্তু একজন নারী কৃষককে কখনই উৎপাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না। কিন্তু কৃষির সব ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা রয়েছে। ফসলের বীজ বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমন কি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারী এককভাবেই করে। প্রায় কোটি নারী কৃষিকাজ, মৎস্যচাষ ও সামাজিক বনায়নের সাথে সরাসরি জড়িত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো কৃষি কাজে জড়িত এ বিপুল নারী শ্রমিকের তেমন কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর এ বিপুল উপস্থিতির কোনো স্বীকৃতি নেই।
নারী অবৈতনিক পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকার পরও শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে অদৃশ্যই রয়ে আছেন।
পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যার ফলাফল ও স্বীকৃতি নেই। কিন্তু এমনই স্বীকৃতিহীন একটি কাজ নিয়মিত করে থাকেন একজন নারী। যে কাজ কে আমরা বলে থাকি গৃহস্থালী কাজ। এই কাজের নেই কোন পারিবারিক ও সামাজিক অর্থনৈতিক মূল্য। স্বীকৃতি-মর্যাদাবীহিন কাজ করতে করতে নারীর শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক জীবন বিকশিত হওয়া তো দূরের কথা নিজেকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ সকাল থেকে উঠেই ঘর ঝাড়া, বাসন মাঝা, রান্না করা, পানি সংগ্রহ, গরু, ছাগল হাস-মুরগিপালন, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, সববজি চাষ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ঝাড়াই, জৈবসার তৈরি করে সংসারে আয়ের জন্য একজন নারী সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী ভূমিকা পালন করেন। আবার নারীদের উৎপাদক হিসেবে গণ্য না করায় কৃষিতে ও পায় না একজন কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি। কিন্তু নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীর মতোই উৎপাদনশীল কজে সমান অংশগ্রহণ করে। ভূমি, ঋণব্যবস্থা, কৃষি উপকরণ কিংবা বাজার- কোনোখানেই তাদের সমান প্রবেশাধিকার নেই। কৃষিতে বেশিরভাগ নারীর অবদান অদৃশ্য থাকে, যা ‘সংসারের কাজ’ হিসেবে পরিগণিত করা হয়। আমাদের আইন, নীতি ও সামাজিক চর্চা সম্পত্তিতে নারীর মালিকানার বিষয়টি সমর্থন করে না। গ্রামীণ নারী ও মেয়েশিশুদের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তারা তাদের পড়াশোনা শেষ করতে পারে না। চাকরিতে সুযোগ থাকে খুবই কম। আর তারা সামাজিক রীতি মানতে বাধ্য থাকে। যা তাদের প্রথাগত গৃহস্থালির কাজ ও পরিবারের যতœ নেওয়ার নির্ধারিত ভূমিকায় যুক্ত করে।
নারী এগিয়ে যাচ্ছে এটি যেমন সত্য, আবার নারী নির্যাতন বেড়েছে সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। করোনাকালে গত তিন বছরে নারী নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। আজ এই সভ্য জগতে বাস করেও আমরা আদিমতাকে বজায় রেখে নারীর প্রতি হিংস্রতা চালিয়ে যাচ্ছি। নারীর প্রতি অবিচার, অনধিকার, অস্বীকার, মারপিট, প্রতিটি কাজে দোষ ধরা ইত্যাদিকে আমরা ছোট করেই দেখি কিংবা কেউ কেউ দেখিই না। নারীর প্রতি নৃশংসতার অন্যতম কারণ হতে পারে ক্ষমতার দাপট, প্রশাসনের উদাসীনতা, স্বাভাবিক বিষয় ভেবে প্রশাসনকে না জানানো, নারীদের চুপ করে থাকা, ভাগ্য বলে মেনে নেয়া প্রভৃতি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা, চিন্তাধারা বদল করে নারীর প্রতি সংবেদনশীল হই সুরক্ষিত করি সকল নারীর অধিকার ।
উল্লেখ্য আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের স্বীকৃতি দানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিনটি। ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে নারী দিবস পালন শুরু করে। এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি পোশাক তৈরি শ্রমিকদের সম্মান জানাতে ১৯০৮ সালে ধর্মঘট ডেকেছিল। নারী শ্রমিকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণের দাবিতে এই ধর্মঘট ছিল। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বনাম আন্তর্জাতিক কর্মজীবি নারী দিবস। ১৯০৯ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইযর্কের নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনের ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ৮ মার্চ, স্বাধিনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবস উদযাপিত হয়। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে দেশে দেশে এই দিবসটি পালনের আহবান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পূনর্ব্যক্ত করার অভীন্সা নিয়ে। বিশ্বের অনেক দেশে এই দিবসকে কেন্দ্র করে সরকারি ছুটির দিন। বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারী পর্যায়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। “ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন” প্রতিপাদ্যের আলোকে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বারসিক ও তার কর্মএলাকায় জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৩ পালনের কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে।