কাঠ খুড়ে জীবন খুঁজি
সাতক্ষীরা থেকে এস.এম নাহিদ হাসান
১৯৬২ সালে সাতক্ষীরা জেলার অর্ন্তগত আশাশুনি থানার পিরোজপুর নাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভাস্কর সুরেশ পা-ে। তার পিতার নাম সূর্য মিস্ত্রি এবং মাতার নাম টুপুদেবী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুবই চটপটে, দুষ্টু এবং মেধাবী। তিনি ১৯৮৫ সালে গ্রামের খাজরা ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে কৃর্তিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও মেধার জন্য তিনি যশোর ক্যান্টমেন্ট কলেজ থেকে সাফল্যের সাথে এইচএসসি পাশ করেন। কিন্ত অভাব তার জীবনের সঙ্গী হওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিকের পর তার আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। তার পিতা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি; কাঠের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ১৯৯০ সালের দিকে জীবিকার তাগিদে সুরেশ পা-ে তাঁর বাবার জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই তার এ কর্ম জীবনের হাতেখড়ি। বাবার সেই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে তিনি কাঠের উপর খোদাই করে বিভিন্ন রকম মুর্তি বানানো শুরু করেন।
তিনি ক্ষুদ্র আকারে প্রথম কাজ শুরু করেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ রোডে প্রান্তিক নামক বাড়ির বিপরীতে একটি ঘরে। তার প্রথম তৈরিকৃত রবীন্দ্রনাথের ছবি কিনেন সাতক্ষীরা শহরের টাউন গালর্স স্কুলের শিক্ষক কৃর্তি মোহন মল্লিক। ৩৭৫ টাকার বিনিময়ে তিনি এ ছবি কিনে নেন। নিজের মনন, একাগ্রতা নিয়ে তিনি তার কাজ চালিয়ে যান।
ধীরে ধীরে তিনি ছোটবড় কিছু কাজ করতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৯৫ সালের ৯ই জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খলেদা জিয়া এবং সাবেক রাষ্টপতি জিয়াউর রহমানের কাঠের উপর খোদাই করা ২টি প্রতিকৃতি বেগম খলেদা জিয়ার হাতে তুলে দেন। ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে সুরেশ পা-ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতির তৈরি করেন। ২ ইঞ্চি কাঠের উপর খোদাই করা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতির উপরে মহান আল্লাহ, নীচে জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু লেখা এবং ডানে দলীয় পতাকা তার বাম পাশে জাতীয় পতাকা। পুরো প্রতিকৃতিটি একটি নৌকার উপর অবস্থিত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিটি ১৯৯৬ সালের সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলায় প্রদর্শনী করেন ভাস্কর সুরেশ পাণ্ডে। মেলায় আশা দর্শনার্থীদের মধ্যে এ প্রতিকৃতি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
উল্লেখ্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দেন। তখনকার বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্র-পত্রিকায় (দৈনিক পত্রদূত, দৈনিক জনকণ্ঠ, আজকের কাগজসহ আরো অনেক ) সুরেশ পাণ্ডেকে নিয়ে লেখা-লেখি হয়। ১৯৯৭ সালের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে জাতীয় শিল্পী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কারুশিল্পী সুরেশ পা-েকে প্রতিমাসে পাঁচশত ৫০০ টাকা হিসাবে বছরে ৬০০০ সম্মানী ভাতা প্রদান করা হয়।
২০০৬ সালে সুরেশ পাণ্ডে সাতক্ষীরা শহরের অদূরে মোজাফফর গার্ডেন নামক একটি পার্কে প্রথমে কনক্রিটের ছোটবড় নানা ধরনের স্থাপত্য স্থাপন করেন। দূর দুরান্ত থেকে আসা বিভিন্ন দর্শনার্থীদের কাছে এ স্থাপত্য অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালের দিকে নারায়ণগঞ্জের আফতাব নামের এক ভাস্কর শিল্পীর সাথে তার পরিচয় হয়। সেই আফতাবের পরামর্শেই তার কাছ থেকে প্রথম ফাইবার এর কাজ শেখেন। কাজ শেখার প্রবল আগ্রহের কারণেই তিনি অতি অল্প সময়ে ফাইবারের কাজ রপ্ত করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি হরিণ, বক, পাখিসহ কিছু ভাস্কর্য্য তৈরি করেন। তারপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকতে হয়নি। ধীরে ধীরে তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি তার তৈরিকৃত ভাস্কর্য্য নিয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করেন। এ মেলা থেকে তিনি বেশ সাড়াও পেয়েছিলেন। মেলায় আগত নেপাল, ইংল্যান্ডসহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন দর্শনার্থীরা তার তৈরি করা বিভিন্ন ভাস্কর্য্য ক্রয় করেন। তিনি বলেন, “সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ সবচেয়ে বেশি বিক্রয় হয়।”
২০১২ সালে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা বিসিক শিল্প এলাকায় জায়গা নিয়ে সুরেশ পাণ্ডে ইন্ড্রাসট্রি গড়ে তুলেছেন। তার এ প্রতিষ্ঠানে ফাইবার গ্লাস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য্য তৈরি করা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন জিনিস তৈরির অর্ডার আসে। এখনে প্রায় ৪৫-৫০ জন শ্রমিক কাজ করছে। সুরেশ পাণ্ডে বলেন, “তার এখান থেকে কাজ শিখে অনেক প্রতিভাবান ছেলেরা অনেক ভালো জায়গা কাজ করছে।” সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাড়িতে স্থান করে নিয়েছে ভাস্কর সুরেশ পাণ্ডের এই ভাস্কর্য্য। শুধু তাই নয় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থান করে নিয়েছে তার ভাস্কর্য্য।
সুরেশ পান্ডে-র উল্লেখযোগ্য স্থাপনাসমূহ:
১. লালমনিরহাটের হাতিয়াবান্দা উপজেলায় ২৫ ফুট লম্বা একটি বিশাল আকৃতির হাতি স্থাপন করেছেন যা “হাতিবান্দা” নামে পরিচিত।
২. ঢাকা রাজেন্দ্রপুর ও রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টসহ বিশেষ করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে বহু স্থাপনা স্থাপন করেছেন তিনি।
৩. “রক্তাত্ব স্বাধীনতা” ভাস্কার্য্যটি তৈরি করেছেন ঝিনাইদাহ জেলার মহেশপুর পৌরসভা বাস টার্মিনালের ত্রি-মাথায়।
৪. “অহিংসার পূর্ণ প্রতীক ভগবান বুদ্ধ” ভাস্কার্য্যটি প্রায় সাড়ে ১৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আর্শিবাদ সূচক এই ভাস্কর্য্যটি ঢাকার আশুলিয়ার বঙ্গবন্ধু সড়কের পার্শ্বে ৬তলা উচ্চতা বিশিষ্ট বোধিজ্ঞান ভাবনা কেন্দ্র নামক একটি বৌদ্ধ মন্দিরের চুড়ায় এটি দণ্ডয়ামান।
৫. ১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মহাকবি মাইকেল মধূসূদন দত্তের একটি পূর্ণ ভাস্কার্য্য তৈরি করেন।
৬. সাতক্ষীরার মোজাফফর গার্ডেনে তার অসংখ্য ভাস্কর্য্য রয়েছে।
এছাড়াও তিনি ২০১৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তার পরিবারের ১৭ শহীদের অবক্ষ ভাস্কর্য্য তৈরি করেন। এই ১৭ শহীদের ভাস্কর্য্য তৈরির কাজ শুরু করেন ২০১৩ সালের দিকে। প্রায় দুই বছর প্ররিশ্রম করে তিনি এগুলো তৈরি করেন। প্রায় তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করে ফাইবার গ্লাস দিয়ে এগুলো করা হয়। সুরেশ পাণ্ডের বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসাবে তার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ছিলো এগুলো বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিবেন।
তিনি একটি ইকোপার্ক তৈরি করতে চান। ইতিমধ্যে তিনি সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের পাশে জমি ক্রয় করে ইকোপার্কের কাজ শুরু করেছেন। এখানে তিনি বিভিন্ন প্রাণির ভাস্কর্য্য ও ১০০ জন মনিষীর ভাস্কর্য্য তৈরি করবেন।
২০১৭ সালের প্রথমে নতুন একটি প্রজেক্ট শুরু করবেন “ফাইবার ডোর”। ফাইবার গ্লাস দিয়ে দরজা তৈরি করে বাজারজাতরণ করবেন। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রায় ১০০ বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে বলে তিনি জানান। কারুশিল্পি সুরেশ পাণ্ডে তার এই কাজের মাধ্যমে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চান। তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চান।