ঋষিপাড়ার জীবনগল্প
সাতক্ষীরা থেকে মো. মনিরুল ইসলাম
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রাজার বাগান গ্রাম একটি ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা। এই এলাকাকে ঘিরে আছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠী বসবাস এই এলাকায়। তাদের মধ্যে বসবাস করে হিন্দু ধর্মের ঋষি সম্প্রদায়। এই এলাকায় প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ ঘর ঋষি সম্প্রদায় লোকের বসবাস। এখানে তাদের বসবাস শুরু হয় সেই জমিদার আমল থেকে। কথিত আছে, জমিদারদের প্রয়োজনে এদের বসতি গড়ে ওঠে এখানে।
এই ঋষি সম্প্রদায়ের আদি পেশা ছিল-জুতা সেলাই করা, নাপিত, চামড়া প্রক্রিয়া-করা, পাঠা পালন ইত্যাদি। কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে এবং কালের পরিক্রমায় তাদের সেই প্রধান পেশাগুলো আজ হারাতে বসেছে। বর্তমানে অল্প সংখ্যক ব্যক্তি তাদের এই পেশায় নিয়োজিত থাকলেও অধিকাংশই প্রয়োজনে পেশার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এখন তারা ভ্যান ও রিক্সা চালানো, দিনমজুরের কাজ, নাপিত, অন্যের জমিতে কৃষি কাজ, রাজমিস্ত্রি, সাইকেল-রিক্সা মেরামত, জুতা সেলাই, চামড়া প্রক্রিয়া, পশু পালন করে জীবনযাপন করছেন। পুরুষদের পাাশাপাশি ঋষি সম্প্রদায়ের নারীরাও কাজ করেন। তাঁরা দিন মজুর ও বাসা বাড়িতে কাজ করে। কেউ কেউ সারাদিন রান্নার কাজে ব্যবহার করার জন্য কাঠ (খড়ি) সংগ্রহ করতে বের হন।
ঋষি সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম। তারা খেলাপড়ার প্রতি মনোযোগী ছিলো না। তাঁদের ছেলেমেয়েরাও শিক্ষায় খুব আগ্রহী হয় না। অল্প বয়সেই তারা সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে নেয়! তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে তাদের এই মনোভাব অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছে। এখন তাদের সন্তানরা স্কুলে যায়। বিশেষ করে এদের মেয়েরা প্রায় সবাই স্কুলে যায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ছাড়াও এদের ছেলে মেয়েরা এখন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। অতীতে তাদের শিক্ষার হার শূন্য থাকলেও বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তাদের পাড়ার ছেলে সুব্রত দাশ বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ছে। সুব্রত দাশের প্রেরণায় এখন অন্যরা পড়ালেখায় মনোযোগী।
ঋষিদেও মধ্যে বাল্যা বিবাহের প্রবণতা একটু বেশি। ছেলে বা মেয়ে হোক খুব অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এই এলাকার ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষেরা অনেক কষ্টে জীবনযাপন করে। অন্যের জমিতে ঘর করে এবং নিজেদের অল্প জমিতে ঘরের সাথে ঘর ঘেঁষে তাদের বসতি। ঠিক যেন অনেক পাখির মধ্যে একটি বাসা। তাদের অল্প বসতভিটা ছাড়া আর কোন জমি নেই। এজন্য তারা পরের জমিতে কৃষি কাজ করেন।
তবে এতো কষ্টের মধ্যেও তারা সব সময় সুখ খুজে বেড়ান। সারাদিন কষ্ট করার পর রাতে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে কিছুটা হলেও মনের ও শারীরিক কষ্ট দূর করার চেষ্টা করেন। রাজার বাগান গ্রামের নারীরা ভাষান গান, রূপক যাত্রাসহ বিভিন্ন ধরনের বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করে থাকেন।
ঋষিদের মধ্য থেকে আদিকালের মতো এখনও দুই একজন সরদার নির্বাচন করে এবং সুবিধা অসুবিধায় তাদের পরামর্শ মতো চলেন। এজন্য তাঁদের মধ্যে নেই কোন মারমারি, নেই কোন হাঙ্গামা। তাদের মধ্যে সর্বদা শান্তিপূর্ণ ভাব বিরাজ করে। তারা অন্যান্য ধর্মের প্রতিও খুবই শ্রদ্ধাশীল। এখানে তারা হিন্দু ও মুসলিম এক সাথে বসবাস।
সর্বোপরি বলা যায় যে, ঋষি সম্প্রদায়দের বিভিন্ন সুবিধা ও অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ধর্মপালন করে সবার সাথে সম্প্রীতি বজায় রেখে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করে করছেন।