গাবুরার কৃষি জীবন পুনরুদ্ধারে কৃষকের প্রচেষ্টা
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
২০০৯ সালে প্রলংয়কারী আইলায় ক্ষত বিক্ষত হয় দক্ষিণের শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন। এর মধ্যে ভয়াবহ ক্ষতির সন্মূখীন হয় উপজেলার ১২নং গাবুরা ইউনিয়ন। সুন্দরবনের পাদদেশের দ্বীপবেষ্টিত গাবুরা ইউনিয়ন লবণ পানিতে একাকার হয়ে যায়। জোয়ারভাটার প্রবল চাপে লবণ পানিতে বিলীন হয়ে যায় কৃষির চিত্র। পরিস্থিতির চাপে কেউ কেউ স্থানান্তরিত হলেও সকলেই আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। সরকারি. বেসরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগে ধীরে ধীরে কৃষি জীবন পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হতে থাকেন।
গাবুরাতে একসময় স্থানীয় জাতের মধ্যে পাটনাই, তালমুগুর, দারশাইল, হামাই, ইঞ্চি, চিনিকানি, জটাইবালাম, গজাল, ঘুনসি, হলদে গোটাল, টিকিরাম পাটনায়, লালগেতি, সাদাগেতি ধান চাষ হতো। অন্যদিকে স্থানীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে মরুল্য, শোল, কৈ, শিং, মাগুর, ট্যাংরা, পুঁটি, চ্যাং, বেতলা, রুই, কাতলা, পোনা, ভেটকি, পারশে, দাঁতনে, পায়রা, ক্যাইন, ভাঙ্গান, তেলাপিয়া, বিভিন্ন কাফ জাতীয় মাছ পাওয়া যেতো। পাখি প্রজাতির মধ্যে পানকৌড়ী, বাটাং, মাছরাঙ্গ, ডাক, ঘুঘু, শালিক, বক, কচ্ছপ, কাঁকড়া, কুচে, ব্যাঙ, সাপ, শামুক, ঝিনুক, ঢ্যাব, শালুক, শকুন, বাদুড়, টুনটুনি, মদন, গাংচিল, দোয়েল, টিয়া ও চড়–ইসহ নানান জাতের পাখি দেখা যেতো। এছাড়া ফলের গাছের মধ্যে আম, জাম, কলা, নারিকেল, পেয়ারা, আতা, আমড়া, সবেদা, জামরুল, বাতাবি লেবু, ডুমুর, তাল, খেজুর, করমচা, কেওড়া, নিম, কদবেল, কুল, তেঁতুল, কাঁঠাল, সুপারি, পেঁপে, গাবসহ বিভিন্ন ফল গাছ দেখা যেতো। এলাকার কৃষাণ ও কৃষাণীরা লালশাক, ডাটাশাক, পালংশাক, সীম, বরবটি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ঢেড়স, চালকুমড়া, উচ্ছে, করল্লা, বেগুন, টমেেেটা, ওল, কচুরমুখী, আদা, হলুদ, শসা, পেয়াজ, রসুন, পুইশাক, সরিষা, মরিচ, আলু,ওলকপি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, মূলা, আলু. মানকচুসহ বৈচিত্র্যময় সবজি ও মসলা চাষ করতেন। এলাকায় অবশ্য কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজির মধ্যে আদাবরুন, তেলাকচু, ঘুম, কলমী, গাদামনি, হেলাঞ্চ, মাটিফোড়া, খুদকুড়ো, হাতিশূর, সেঞ্চি, ঘোড়া সেঞ্চি, কাটানটি, গিমে, থানকুনিসহ নানান বনজ শাক পাওয়া যেতো।
ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপ জনপদ গাবুরাতে আইলার পরে বিভিন্ন এনজিও এবং সরকার দূর্গতদের উন্নয়নে কাজ করেন। মানুষের ত্রাণনির্ভর সহযোগিতার পাশাপাশি জীবন-জীবিকার মান উন্নয়নে নানা প্রকারের সহযোগিতা আব্যাহত থাকলেও কৃষির চিত্র পাল্টাতে পারেনি। শ্যামনগর উপজেলার ৩৩ বর্গমাইল আয়তনের এই দ্বীপ জনপদে ২০১৪ সালে চকবারা গ্রামের কৃষক আবু মূসার জমিতে গ্রামের সকলে মিলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ পরবর্তী কৃষি নিরাপত্তায় নিজেদের বীজ বিনিময় কেন্দ্র ও কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর জীবনযাত্রা সমৃদ্ধ করতে একটি কৃষক সংগঠন তৈরি করেন। এলাকার সকল কৃষক ও কৃষাণী স্থানীয় কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে ঝাপিয়ে পড়েন। বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদ, এলাকা উপযোগি বনায়ন, প্রাণী সম্পদ পালন, পুকুর ও জলাশয়ে স্থানীয় জাতে মাছ চাষসহ স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা আব্যাহত রেখেছেন।
এভাবে কৃষকদের নিরলস প্রচেষ্টায় কিছু কিছু কৃষি বাড়ি সমন্বিত কৃষি খামের পরিণত হয়েছে। বর্তমানে গ্রামের প্রায় বাড়িতে স্থানীয় জাতের লালশাক, ডাটাশাক, পালংশাক, সীম, বরবটি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ঢেড়স, চালকুমড়া, পুঁইশাক, তরুল, ঝিঙ্গা, শসা, করল্লা, ওল ও কচুরমুখীর বীজ আছে। এছাড়া হলুদ, সরিষা ও গম বীজও অনেক কৃষক সংরক্ষণ করেছেন। এখানে গুরু ও ছাগলের সংখ্যা কম হলে ও প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, মুরগি ও কবুতর। এই প্রসঙ্গে কৃষক আবু মুছা সরদার বলেন, “গাবুরাতে দিনের পর দিন কৃষিতে উন্নয়ন হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের বাগানে, পাঁচ প্রজাতির বেগুন, টমোটে, পালংশাক, লালশাক, ডাটাশাক, ঢেড়স, কপি, পুইশাক, বরবটি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ঝাল, উচ্ছে, মৌরি, হেন্না, তিল, মুগডাল ও ভুট্টা সহ নানা ফসল বৈচিত্র্য রয়েছে। মৌসুমভিত্তিক সব ধরনের বীজ সংরক্ষণ করি আমরা।”
পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তায় ও কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় ফলের বীজ ব্যাংক-কৃষি উপকরণ, প্রযুক্তি এবং জল-জমি ও জলাশয় সুরক্ষায় গাবুরার কৃষক-কৃষাণী যে প্রচেষ্টা চলমান রেখেছেন তার মাধ্যমে ফিরে পাবে কৃষির স্বাভাবিক চিত্র। অচিরেই কৃষকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গাবুরা ফিরে পাবে স্থায়িত্বশীল কৃষির পূর্ণতা সুরক্ষিত হবে কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য।