রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন স্মরণে
কাজী সুফিয়া আখতার
১৯০৪ সালে, যখন অখন্ড ভারতবর্ষের রাজনীতি,সাম্প্রদায়িকতা নানা সংবর্ত সৃষ্টি করছে, তখন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন ঐতিহ্যিক রক্ষণশীল পরিবারে ও পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে এবং বেড়ে ওঠে মাত্র ২৪ বছর বয়সে লিখেছেন, পুরুষশাসিত সমাজে কেবল গায়ের জোরে মেয়েদের বঞ্চিত করা হয়েছে সকল ন্যায্য অধিকার থেকে। প্রবল বাধা অগ্রাহ্য করে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন,অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রুপ অস্ত্রাঘাতেতাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।…আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈম্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।
ভাবতেঅবাক লাগে, যখন বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদগণ ধর্ম নিয়ে কথা বলতে সাহস পাননি,খন্ড খন্ড ভাবে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেই সময়ে তিনি অকুতোভয়ে, দ্বিধাহীন চিত্তে নারীর দুর্দশার জন্য ধর্মীয় বিধিবিধান নামে পুরুষদের প্রচারণাকে দায়ী করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। লিখেছেন, ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছে।’
রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্ধ গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু। বড় বোন করিমুন্নেসার কাছে বাংলা এবং ভাই ইব্রাহিম সাবের এর কাছে ইংরেজী শিখেন।
বাংলার প্রথম নারীবাদী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর ১৪০ তম জন্মবার্ষিকীতে অশেষ শ্রদ্ধা জানাই কাজী সুফিয়া আখ্তার নারী জাগরণের অগ্রদূত, বাঙালি নারীর অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি সংগ্রামের পথিকৃৎ, শিক্ষা বিস্তারে নিরলস সাধক, মুক্তি ও মুক্ত চিন্তার উদ্বুদ্ধুকারী সাহিত্যিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর লেখা প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদির ভাব ও প্রকরণ বিশ্লেষণ করে শিক্ষাবিদ ও গবেষক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী মন্তব্য করেছেন যে, “অন্য উদ্দেশ্যে নয়ই, সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যও নয়,রোকেয়া লিখেছিলেন ‘দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন’ করবার জন্য।” “স্ত্রী জাতির অবনতি” প্রবন্ধে শিক্ষা বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। এই প্রবন্ধে প্রথমেই শিক্ষা বিষয়টি আসেনি। এসেছে সমাজে নারীর অবনতির ভয়াবহ বর্ণনার পরে। এখানে নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে দাসী হিসেবে। এই দাসত্ব থেকে নারীকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রসঙ্গটি এসেছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে। নিম্নে কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি, যা এখনো সমানভাবে প্রযোজ্য ও প্রাসঙ্গিক – ‘ প্রকৃত সুশিক্ষা চাই যাহাতে মস্তিষ্ক ও মন উন্নত হয়।’ তিনি বিশ্বাস করতেন,সুশিক্ষার অভাবেই হৃদয়বৃত্তি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। তিনি আরো লিখেছেন, “শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের ‘অন্ধ অনুকরণ’ নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক গেয়ান বা ক্ষমতা ( Facult) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা। ঐ গুণের সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ ।”
“আমরা কেবল ‘পাস করা বিদ্যা’- কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না। ” নারীকে তিনি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার কথা চিন্তা করেছিলেন। এজন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রসারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। রোকেয়া ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ৯ ডিসেম্বর, রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে রক্ষণশীল জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু। তিনি বড় বোন করিমুন্নেসার কাছে বাংলা এবং বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের এর কাছে ইংরেজি শিখেছিলেন। ১৬ বছর বয়সে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে বিহারের ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি দুই শিশু কন্যার মা হয়েছিলেন। কিন্তু তারা শৈশবেই মারা যায়। তাঁর স্বামী উদারচিন্তার মানুষ ছিলেন। তিনি রোকেয়াকে শিক্ষায় উৎসাহিত করেন। ইংরেজি শিক্ষায় সাহায্য সহযোগিতা করেন। স্বামীর উৎসাহে এবং নিজের, নারীদের কল্যাণে কাজ করার তীব্র ইচ্ছা, অদম্য মনোবলে ও আগ্রহে কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত ও নবনূর’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম রচনা ‘ নিরীহ বাঙালি ‘১৩১০ সালে মাঘ মাসে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় তাঁর লেখা ‘ বোরকা’, ‘স্ত্রীজাতির অবনতি ‘, গৃহ,’ ও ‘অধাঙ্গী’ প্রবন্ধগুলো ১৩১১ সালের বৈশাখ, ভাদ্র, ও আশ্বিন মাসে প্রকাশিত হয়। এগুলো ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘মতিচুর ‘ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৯০৯ সালে মে মাসে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে তিনি ভাগলপুরে পাঁচ জন ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯১০ সালের শেষের দিকে তিনি ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন। এবং ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেন এ একটি বাড়িতে স্কুলটি পুনরায় ১৯১১ সালের মার্চ মাসে শুরু করেন আটজন ছাত্রী নিয়ে। ছাত্রী সংখ্যা বাড়ার কারণে ১৯১৩ সালে ৯ মে ১৩ নং ইউরোপিয়ান এ্যাসাইলাম লেন এ স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯১৫ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারী ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে এই স্কুল ৮৬/ এ লোয়ার সার্কুলার রোডে স্থানান্তরিত করা হয়। বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য তাঁকে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়েছে। এর বিনিময়ে তিনি কি পেয়েছেন? ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর চাচাতো বোনকে লেখা এক চিঠিতে লিখেছেন, “আমার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরিবর্তে সমাজ বিস্ফারিত নেত্রে আমার খুঁটিনাটি ভুলভ্রান্তির ছিদ্র অন্বেষণ করিতে ই বদ্ধপরিকর। “
রোকেয়ার মধ্যে উগ্র নারীবাদের প্রকাশ কখনো দেখা যায়নি। নারী মুক্তির বিষয়টি তাঁকে আলোড়িত করেছিল ভীষণভাবে। তাঁর চিন্তা ও কর্মে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। সীমাবদ্ধতা ছিল না। তিনি যে নারী প্রধান সমাজ ও রাষ্ট্রের কথা ‘Sultana’ s Dream’ বা সুলতানার স্বপ্ন গ্রন্থে চিন্তা করেছেন, আমার মনে প্রত্যয় জাগে তা নিছক স্বপ্ন বা কল্পনা নয়। একদিন তা বাস্তব রূপ নিবে। যদি আজকের তরুণীরা রোকেয়াকে সম্যক ভাবে পাঠ ও চর্চা করতে সক্ষম হন। কারণ,সেই বদ্ধ অন্ধকারময় সমাজে জীবন যাপন করে, সমাজের নারী ও পুরুষের সাম্য ও সমাজের উন্নতির জন্য তিনি যে কী গভীর ভাবে চিন্তা করে লিখেছেন, “আমরা সমাজেরই অর্ধ অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে- একই।”
সমাজের স্বার্থে নারী পুরুষের সমকক্ষতার বিষয়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর চিন্তা অনেক দূরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে। সমসাময়িক পন্ডিত ও সমাজ সংস্কারকদের চাইতে এই বিষয়ে তাঁর চিন্তা অনেক প্রাগ্রসর ছিল। মহীয়সী এই নারী ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ৯ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। তাঁকে জানাই বিনম্র চিত্তে গভীর শ্রদ্ধা।
প্রোফাইল ছবিটি, ইন্টারনেট উন্মুক্ত উৎস থেকে সংগৃহীত