সাম্প্রতিক পোস্ট

“অহন একটু সুখের মুখ দেখছি”

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
“আমার ঘরে অহন ভাতের অভাব নাই। তিনবেলা খাওন, কাপড় চোপড় কিনা আর মাইয়ারার পড়ালেহা সব ভালো মতো চলতাছে। কয়েক বছর আগেও একবেলা কইরা খাইতাম। কত কষ্টে দিন কাটাইছি। অহন একটু সুখের মুখ দেখছি”। হাসি হাসি মুখ করে এই কথাগুলো বলেছিলেন চকপাড়া গ্রামের সেলিনা আক্তার। তিনি নিজের সংসারের ব্যয়ভার বহনের জন্য বাড়িতে প্রাণি সম্পদ পালন করেন।


চকপাড়া গ্রামের জালাল মিয়ার সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে প্রায় বিশ (২০) বছর আগে। দরিদ্র স্বামীর সংসারে এসে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। একদিকে স্বামী দিনমজুর অন্যদিকে সহজ সরল। অনেকেই তাঁর এই সরলতার সুযোগ নিয়ে কাজ করানোর পরও পারিশ্রমিক দিতো না। তাই কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হতো তাঁদের।


এভাবে যখন আর চলতে পারছিলেন না তখন সেলিনা আক্তারের ভাই তাঁকে একটি গরু কিনে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন এই গরু পালনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও অভাব দূর করতে পারবেন। সেই থেকে শুরু হয়েছিল। এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।


গরুর বাছুর, দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে সংসারের কিছু চাহিদা পূরণের পাশাপাশি টাকা জমাতে থাকেন। জমানো টাকা দিয়ে ছাগল কিনলেন। আস্তে আস্তে গরু আর ছাগলের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। ছাগল বিক্রি করে হাঁস ও মুরগি কিনলেন। আর গরু বিক্রির টাকা জমিয়ে ৫ শতাংশ জায়গা কিনে সেখানে একটি বাড়ি তৈরি করলেন। স্বামীর সরলতার সুযোগ নিয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জায়গাটুকু থেকেও তাঁকে বঞ্চিত করে। তাই তিনি অন্যত্র জায়গা কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন।


সেলিনা আক্তারের তিন মেয়ে, তারা সবাই পড়ালেখা করছে। বড় মেয়ে এবছর এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিচ্ছে। অন্য একজন এস.এস.সি পরীক্ষার্থী এবং ছোট মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েদের পড়ালেখাসহ যাবতীয় খরচ আসে তাঁর হাঁস, মুরগি আর ছাগল বিক্রির টাকা থেকে।


তাঁর বাড়িতে বর্তমানে গরু ৩টি, ছাগল ৫টি, পাঁতিহাঁস ৩টি, রাজহাঁস ৩টি, মুরগি ১০টি এবং কবুতর আছে ১০ জোড়া। কয়েক মাস হলো তিনি কবুতর কিনেছেন। স্থানীয় জাতের পাশাপাশি তাঁর বাড়িতে গিরিবাজ, বোম্বাই জাতের কবুতরও আছে। তিনি হাঁস, মুরগির ডিম বিক্রি না করে মেয়েদেরকে খেতে দেন। আর কিছু ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটান। একটি রাজহাঁস বছরে দুইবার ডিম দেয়। ডিম দিয়ে তিনি বাচ্চা ফোটান। বাচ্চাগুলো বড় হলে প্রতিটি হাঁস তিনি ১৫’শ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন।


সংসারের কাজের সময়টুকু বাদ দিয়ে তিনি দিনের বেশিরভাগ সময়ে প্রাণিসম্পদগুলোর যতœ করেন। গরুর জন্য ঘাস সংগ্রহ করা, হাঁস, মুরগি, কবুতরের খাবার দেয়া সব তিনি একাই করেন। গম, ধান, চাল এগুলো কবুতরের খাবার হিসেবে দিতে হয়। এক জোড়া কবুতরের বাচ্চা তিনি ৫’শ থেকে ৬’শ টাকা দিয়ে বিক্রি করেন।


প্রাণিসম্পদ বিক্রির টাকায় সংসারের চাহিদা পূরণ আর মেয়েদের পড়ালেখার খরচ মেটানোর পাশাপাশি তিনি কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারেন। আর স্বামী কাজ করে যা পায় তা জমা রেখে ধান কিনে থাকেন। কারণ তাঁদের কোনো কৃষি জমি নেই। তাই সারা বছর খাবারের জন্য ধান কিনে নিতে হয়। বাড়ির একপাশে ছোট্ট একটি পুকুর আছে। সেই পুকুর থেকেই তিনি সারাবছর মাছ সংগ্রহ করেন। প্রতিবছর তিনি পুকুরে ৩ হাজার টাকার মাছের পোনা ছাড়েন। তাই বাজার থেকে তাঁর কোনো মাছ কিনতে হয় না।


পুকুরের চারদিকে তিনি মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন সব্জী চাষ করেন। এগুলোই তাঁর পরিবারের চাহিদা পূরণ করে। তিনি মাটিতে গর্ত করে সেখানে প্রাণিসম্পদের বিষ্ঠা, তরকারির খোসা ইত্যাদি দিয়ে রাখেন এবং গর্ত ভরাট হয়ে গেলে তা মাটি দিয়ে বন্ধ করে দেন। কিছুদিন পরে সেখানে বীজ রোপণ করেন। এভাবে রোপণ করা গাছে প্রচুর সব্জী হয়। এই পদ্ধতিটি তিনি শিখেছিলেন বারসিক’র একটি কর্মশালায়। ৪ (চার) বছর আগে উক্ত গ্রামে জৈব সার তৈরী বিষয়ক কর্মশালায় সেলিনা আক্তার উপস্থিত ছিলেন। সেই দিনের শিখনকে কাজে লাগিয়ে তিনি সব্জীর ফলন বেশি পাচ্ছেন। তাঁর চাহিদা পূরণের পরেও কিছু সব্জী বিক্রি করতে পারেন।


পুকুরের এক পাশে কলাগাছের বাগান আছে। সেখানে বিভিন্ন ধরণের দেশি কলার ছড়ি হয়। এসব কলা তিনি হালি হিসেবে বিক্রি করেন। কারণ এভাবে বিক্রি করলে দাম ভালো পাওয়া যায়। যেখানে দাম একটু বেশি পাওয়া যায় সেখানেই তিনি সব্জী বা প্রাণিসম্পদগুলো বিক্রি করতে চেষ্টা করেন । বেশিরভাগ সময়ে তাঁর বাড়ি থেকেই এগুলো বিক্রি করতে পারেন। মাঝে মধ্যে এগুলো তিনি তাঁর স্বামীর সাহায্যেও বিক্রি করে থাকেন। সেলিনা আক্তারের সংসারে এখন কোনো অভাব নেই। প্রাণিসম্পদ বিক্রির সঞ্চয়কৃত টাকা দিয়ে তিনি আরো ১৫ শতাংশ জায়গা কিনেছেন। ভবিষ্যতে এখানে তিনি ধান চাষ করবেন।


একজন নারী নিজের বুদ্ধিমত্তা, মমতা আর সঞ্চয়ী মনোভাব নিয়ে একটি পরিবারকে সাজিয়ে তোলেন। এসব গুনের পাশাপাশি আরো থাকে একাগ্রতা, দৃঢ়তা আর কঠিন মনোবল। সব মিলিয়ে একজন নারী অতুলনীয়। যুগ যুগ ধরেই নারীকে বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। সেটা হোক পরিবার বা সমাজ। যে সমাজে নারীর কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই, সেই সমাজেই অসংখ্য সেলিনা’রা বিভিন্ন কাজ (অর্থ উপার্জনের সাথে যুক্ত) করে সংসারের খরচ বহন করছেন। এখানে একজন নারী শুধু তার পরিবারের ব্যয় সাশ্রয়কারী নয়, তিনি সংসারের চালক। নিজের জ্ঞান, চিন্তাচেতনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের শত শত নারী অর্থনৈতিকভাবে সংসারের চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছেন। নাইবা থাকলো তাঁদের কাজের স্বীকৃতি তবুও তাঁরা এসবের উর্ধ্বে গিয়ে নিজের স¦ভাবজাত আচরণে পরিবারের হাল ধরে রেখেছেন। টিকিয়ে রেখেছেন সংসার, বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজের ভালোবাসার মানুষদের।

happy wheels 2

Comments