আলোর পথে সাধারণ পাঠাগার: খুলে যাক আলোর দুয়ার
নেত্রকোনা থেকে আওলাদ হোসেন রনি
বই এর গুরুত্ব অল্পকথায় কখনোই বলে শেষ করা সম্ভব নয়। চার্লস ল্যাম্ব বলেছিলেন ‘যে বই পড়ে তার শত্রু কম।’ বাংলাদেশ সরকারের গণগ্রন্থাগার বিভাগের বহুল প্রচারিত একটি স্লোগান ‘পড়িলে বই আলোকিত হই, না পড়িলে বই অন্ধকারে রই।’ অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে যে পথের প্রয়োজন হয় তার নাম বই। আলোতে আসার এই পথ মসৃণ হয় পাঠাগারের মাধ্যমে। এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে সারা বাংলাদেশে শুধুমাত্র নয় সারা দুনিয়াতেই পাঠাগারকে কেন্দ্র করেই সমাজ বিনির্মাণের এক আলোকিত পথ সন্ধান করেছেন সমাজ নির্মাণের কারিগরেরা। আজ আমরা তেমনই কিছু কারিগরের গল্প শুনবো।
নেত্রকোনা জেলা শহর থেকে ৮/৯ মাইল দক্ষিণে পলাশ হাটি গ্রাম। নাগরিক জীবনের কোলাহলমুক্ত ছায়াসুনিবিড় একটি গ্রাম। নামের মতোই দেখতেও ছবির মতো সুন্দর গ্রামটি। এই গ্রামের গল্পও আর দশটি গ্রামের মতোই। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক অপূর্ণতা ছিল এই গ্রামের একটি মূল সংকট। এই সংকট সমাধানে বরাবরের মতোই এগিয়ে আসেন এই গ্রামেরই কয়েকজন কিশোর-তরুণ। সবাই মিলে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত করে একটি পাঠাগার। ‘আলোর পথে সাধারণ পাঠাগার’। পাঠাগারের শুরুর গল্পটা কঠিন। নানান বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাদেরকে। সেই কিশোর তরুণরা এই পথ পাড়ি দিতে মোটেও বিচলিত হননি। সবাই মিলে পরের জমিতে ধান কেটে অর্থ সংগ্রহ করলেন তাঁরা। কেনা হলো বাঁশ, কাঠ, টিন। কিন্তু পাঠাগারের জন্য জমি দরকার। এলাকার মুরুব্বিরা এগিয়ে এলেন এসময়। ব্যবস্থা হলো জায়গা। ছোট্ট মতো একটি ঘর তৈরি হলো বটে কিন্তু বই? না, শুভ উদ্যোগ কখনোই আটকায় না। নিজেদের দেয়া বই এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে চেয়ে আনা বই মিলিয়ে একটি মানানসই সংগ্রহও হলো তাদের। এরপর তাঁরা দ্বারস্থ হলেন সরকারের। তাঁরাও তাঁদের নিরাশ করেননি। উপজেলা পরিষদ তাঁদেরকে দুইটি বইয়ের শেলফ দিয়ে সহযোগিতা করলেন। এখন এই পাঠাগার একটি সফল, সমৃদ্ধ এবং কার্যকর পাঠাগার। দিনের বেলায় এলাকার শিক্ষার্থীরা বই পড়েন, পত্রিকা পড়েন আবার সন্ধ্যায় আসেন এলাকার মুরুব্বিরা। পত্রিকার খবর নিয়ে আলোচনা হয় তাদের মধ্যে। কারণ দেশের খবর রাখার জন্য পত্রিকাই এখন পর্যন্ত সেখানে একমাত্র মাধ্যম। বিদ্যুৎ এখনো সেখানে পৌঁছায়নি এবং টিভি এখনো সেখানে সহজলভ্য নয়।
এতো গেলো পাঠাগার প্রতিষ্ঠার গল্প। এই পাঠাগারকে কেন্দ্র করেই এই এলাকার তরুণরা তৈরি করেছেন বিজয়ের আরো দুর্দান্ত সব মানবিক গল্প। প্রতিষ্ঠার পর পাঠাগারের সব সদস্য মিলে চাঁদা আদায় করে ঈদুল আযহায় গরু কোরবানি দিলেন। কোরবানির গরুর মাংস সারা গ্রামের আর্থিকভাবে দৈন্য মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিলেন তাঁরা। মানুষের ফুটে উঠলো হাসি। হাসি তাঁদের মুখেও। সেই হাসি অমলিন রাখতেই গ্রামের দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বৃত্তিসহ শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করলেন।
গ্রামে কোন খেলার মাঠ নেই। খেলার মাঠের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই একটি খেলার মাঠ তৈরি করলেন তাঁরা। গ্রামের তরুণ-যুবকরা আবারো একটি বিজয়ের মাইল ফলক অর্জন করলেন। গ্রামের মেঠোপথ। বৃষ্টিতে কাদায় পথ চলা কঠিন। রাস্তা সংস্কারের দায়িত্ব নিলেন তাঁরা। করলেনও। আলোর পথে সাধারণ পাঠাগার গ্রামের রাস্তায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ করে প্রতিবছর। মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে প্রতিবছর আয়োজন করে রাত্রিকালিন শর্টগ্রাউন্ড ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। এভাবেই এলাকার মানুষের কাছে শুধু নয় পুরো নেত্রকোনা সদর উপজেলায় ‘আলোর পথে সাধারণ পাঠাগার’ এখন একটি বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য নাম।
এ গ্রামেরই মেধাবী শিক্ষার্থী রাহিমা আক্তার। এসএসসি পরীক্ষায় অর্জন করেছেন জিপিএ ৫। কিন্তু পারিবারিক দারিদ্রতার কারণে পড়াশোনা বাদ দিতে হলো তাঁকে। ভর্তি হতে হলো গার্মেন্টস-এ। আলোর পথে সাধারণ পাঠাগারের সদস্যরা শুনলেন সে কথা। তাঁরা যোগাযোগ করলেন তাঁর সাথে। ফিরিয়ে আনলেন তাঁকে পড়াশুনায়। পড়াশুনার খরচ চালানোর দায়িত্ব নিলেন। রাহিমা ভর্তি হলেন এইচএসসি তে। আবারো অর্জন করলেন জিপিএ ৫। রাহিমা এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের শিক্ষার্থী। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আলোর পথে সাধারণ পাঠাগারের বিজয় মুকুটে যুক্ত হলো আরো একটি পালক।
সর্বশেষ, এ বছর মার্চে ‘আলোর পথে সাধারণ পাঠাগার’ আয়োজন করেছিল কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনার। আয়োজনে মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার এবং প্রধান অতিথি জেলা শিক্ষা অফিসার। অতিথিরা আলোর পথে সাধারণ পাঠাগারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এ প্রজন্মই এভাবেই একটি সুন্দর আগামী নির্মাণ করবে।
বাংলাদেশজুড়ে এরকম মানবিক সমৃদ্ধির বিজয় গাঁথা তৈরি করছেন। যেমনটি বলেছেন বাংলাদেশের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম- ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নূতনের কেতন ওড়ে।’ আমাদের মানবিক উদ্যোগগুলোও এভাবেই সেই মানবিক ‘আলোর পথে সাধারণ পাঠাগার’ এর আলোর পথ ধরে সামনে এগিয়ে যাবে এমনটাই আমরা মনে করি।