সবুজ চিন্তার মানুষ শিক্ষক মো. নূরুজ্জামান
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
“গাছগুলোর গুড়ায় যখন পানি শুকিয়ে যায়, তখন আমার কানের কাছে একটা আওয়াজ আসে, পানি চাই পানি দাও, তখন আমি গাছে পানি দেওয়ার জন্য মনের ভিতর এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করি, হাজার কাজের মধ্যেও আমি ছুটে যাই গাছের কাছে।” কথাগুলো বলছিলেন নেত্রকোনা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও একজন সত্যিকারের প্রকৃতি প্রেমিক মো. নূরুজ্জামান। মো. নূরুজ্জামান সেই মানুষ যিনি কিনা ছোটবেলা থেকে বাবার পিছু পিছু শীত, বর্ষা ও রৌদ্র উপেক্ষা করে ফসলের মাঠে ছুটে যেতেন একটি বীজ বপনের জন্য, গাছের গোঁড়ায় পানি দেওয়ার জন্য। মনের ভিতর গাছের জন্য তাঁর এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করতো ছেলেবেলা থেকেই। পিতা কৃষক মো. আব্দুল গনির প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাই গাছকে ভালোবাসতে তাঁকে প্রেরণা যুগিয়েছে। নেত্রকোনা জেলার মদন থানার কদমশ্রী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন মো. নূরুজ্জামান। এক ভাই, এক বোন ও মা, বাবার সাথে গ্রামেই বড় হয়েছেন তিনি।
নেত্রকোনা আঞ্জুমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মার্স্টাস পাশ করেন। পড়াশুনার জন্য নেত্রকোনা থেকে অনেক দূরে থাকলেও নেত্রকোনার মাটি ও মানুষের জন্য তাঁর ভালোবাসা সব সময় তাকে পিছু টেনেছে। তাই পড়াশুনা শেষে বড় চাকরি নিয়ে বড় কোন শহরে না গিয়ে চলে আসেন নিজ জেলা নেত্রকোনায়। লেখাপড়া শেষ করে ভালো ভালো অনেক চাকুরি সুযোগ পেলেও পেশা হিসেবে বেঁছে নিয়েছেন শিক্ষকতাকে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “নতুন প্রজন্মর জন্য কিছু করতে হলে শিক্ষকতা একটি উত্তম পেশা”। তিনি প্রথম সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেনে নেত্রকোনা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে ২০১১ সালে যোগদেন নেত্রকোনা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বর্তমানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। এই দায়িত্ব তাকে তার স্বপনের কাছাকাছি আসার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। তিনি শিক্ষা জীবনে যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই খুঁজে ফিরেছেন বইপত্রে লেখা বিভিন্ন ফুলের গাছ ও বিলুপ্ত প্রজাতির বৃক্ষকে। তিনি নিজ বাড়িতে বাবার সাথে সব সময় গাছের পরিচর্চা করেছেন, গ্রামীণ জীবনকে উপভোগ করেছেন ফসলের যত্ন করে, নদী-খাল-বিলে মাছ ধরে। তিনি সব সময় স্বপ্ন দেখতেন তার এমন একটি স্বপনের বাগান হবে, যেখানে ফুল, ফল, ঔষধি গাছে ভরা থাকবে। যেসব গাছের নাম তিনি সারাজীবন বই পুস্তকে পড়েছেন, গানের মাঝে শুনেছেন ছেলেবেলা থেকে, সেই সব ফুল দেখার এবং সংরক্ষণের।
নিজের সেই স্বপ্নকে নতুন প্রজন্মের সামনে বাস্তবে তুলে ধরে বাস্তবমূখী শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন, যা দেখে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জেগে ওঠে সহজেই। তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলটিতে একটি সবুজ স্কুল ক্যাম্পাস গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। নিজের চেষ্টায় বর্তমানে গড়ে তুলেছেন একটি সুন্দর এবং শিক্ষণীয় স্কুল প্রাঙ্গন। তিনি স্কুলে যেসব ফুলের গাছ রোপণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে কামিনী, গাঁদা, চেরি, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, কচমস, জিনিয়া, বাগান বিলাশ, রঙ্গন, সন্ধ্যামালতী, জবা, টগর, সিলভিয়া, বেলী, রক্তজবা, সাদা জবা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, কাঞ্চন, কলাবতী, বকুল, কৃষ্ণচুড়া, রক্তকরবী। ঔষধি গাছের মধ্যে রয়েছে পাথরশীলা, তুলসী, অর্জুন, বেল, পুদিনা, থানকুনি, নিসিন্দা, ঘৃতকাঞ্চন। ফলজ গাছগুলোর মধ্যে-আম, কাঁঠাল, জাম, পেঁয়ারা, কলা, জলপাই, কামরাঙ্গা, জাম্বুরা, নারকেল, পেঁপে, সুপারি, বড়ই ও বেল সংরক্ষণ করেছেন। এছাড়াও মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন সবজি চাষ করেন স্কুলের এক পাশে।
স্কুলে পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সাথে বৃক্ষ পরিচিতি বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা করেন এবং নেত্রকোনার বিভিন্ন কবিরাজদের নিয়ে ঔষধি গাছ পরিচিতি বিষয়ে ক্লাসে আলোচনার ব্যবস্থা রাখেন, যার ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্য পুস্তকের বাইরে প্রকৃতি বিষয়ে অনেক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে। স্কুল শেষে নিজ হাতে ফুল ও গাছের যত্ন তিনি নিজে করে থাকেন। সুন্দর ও সবুজ প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা একটি শিক্ষাঙ্গন গড়ার লক্ষ্যে তিনি সব সময় সহকর্মীদের পরার্মশ নিয়েছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “স্কুলে শিক্ষার পাশাপাশী প্রতিটি কাজে সফলতার জন্য প্রয়োজন সকল শিক্ষকদের পরস্পরের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতা”। পারস্পরিক সম্পর্কে উন্নয়ন এবং কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি স্কুল শেষে সহকর্মীদের সাথে চায়ের আড্ডায় বসেন। আড্ডায় চলে পরিবেশ উন্নয়নে করণীয় বিষয়ে আলোচনা। সকল শিক্ষকদের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব বণ্টন করে দেন।
নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্বের সঠিক শিক্ষা প্রদান এবং পরিবেশ রক্ষায় আগামী দিনে অগ্রনায়ক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি প্রতিটি ক্লাসে ঋতুবৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করেন। প্রতিনিয়ত প্রকৃতির এ পরিবর্তনে মানুষের করণীয় বিষয়ে স্কুলের শিক্ষা, সংস্কৃত ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন স্কুল কেবিনেটের উপর। স্কুল কেবিনেটের উদ্যোগে স্কুল পর্যায়ে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক অনুষ্ঠানের, প্রদর্শন করা হয় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ভিডিও চিত্র, আয়োজন করা হয় বিভিন্ন বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতা, নিজের এলাকা প্রাণ-প্রকৃতিকে জানা ও নতুন প্রজন্মের সামনে স্বদেশ প্রেম জাগ্রত করার লক্ষ্যে বারসিক’র সহায়তায় বিভিন্ন সময় আয়োজন করেন কুইজ কুইজ প্রতিযোগিতা।
একজন সবুজ চিন্তার মানুষ শিক্ষক মো. নূরুজ্জামানের পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণে এ যুগের একজন জীবন্ত উদাহরণ। তাঁর মতো সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষকমন্ডলীই যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় জাতের ফুল, ফল ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণ করে স্কুল ক্যাম্পসগুলো সবুজে ভরে তোলেন তাহলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য যেমন সংরক্ষিত হবে, তেমনি পরিবেশ হবে সুন্দর ও অনাবিল এবং সমৃদ্ধ হবে প্রাণবৈচিত্র্য। ফুলের ও প্রকৃতির ন্যায় স্নিগ্ধ ও পবিত্রতায় ভরে থাকবে সকল শিক্ষার্থীদের মন। আসুন আমরাও স্বপ্ন দেখি একটি সবুজ দেশ গড়ার। গড়ে তুলি নিজ নিজ বাড়ির আঙ্গিনা, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ছড়িয়ে দিই সবুজ ভাবনাকে সকলের মাঝে, অবদান রাখি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, রক্ষা ও পরিবেশ রক্ষায় এবং সবুজ একটি পৃথিবী গড়ায়।