একজন রিকু রাণী পাল এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্র

একজন রিকু রাণী পাল এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্র

:: নেত্রকোণা থেকে পার্বতী রানী সিংহ

IMG_20151028_112836রিকু পাল। নেত্রকোণার উদ্যোগী ও প্রত্যয়ী একজন তরুণী। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত কুমারের জনগোষ্ঠীর একজন প্রতিনিধি তিনি। কুমারের সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পেশার কদর হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শিক্ষা-দীক্ষায়ও যেন তাঁরা পিছিয়ে পড়তে শুরু করেন। আধুনিক প্লাস্টিকজাত নিত্যদিনের পণ্য আর্বিভাবে পর থেকেই কুমার সম্প্রদায়ের শিল্পকর্মের কদর দিনকে দিন কমে গেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে তাঁদের অনন্য সংস্কৃতিও! ফলে দারিদ্রতার কষাঘাতে তাঁরা শিক্ষা-দীক্ষায় মনোযোগী হওয়ার চেয়ে জীবিকার অন্বেষনের দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছেন বেশি। বাঁচতে হবে যে তাঁদেরকে!

রিকু রাণী পালকে এই দারিদ্রতা ও নানান সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে তিনি ক্ষান্ত হওয়ার পাত্রী নন। নিজ ভাগ্য পরিবর্তন এবং বঞ্চিত ও পিছিয়ে থাকা তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের জন্য একজন আলোকবির্তকারূপে আবির্ভূত হওয়ার জন্য শিক্ষাকে বেছে নেন তিনি। দরিদ্র পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান তিনি। শিক্ষাকে বেছে নেওয়া খুব একটা সহজ কাজ ছিল না তাঁর জন্য। তবে পিতামাতার সমর্থন তাঁকে সামনের পথে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। তাই প্রতিকূলতাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে শিক্ষালাভ করতে শুরু করেন। একটু একটু করে পা বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে প্রবেশ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে তিনি উপলদ্ধি করেন কুমার পেশা কোন নিচু জাতের কাজ নয়; এটি একটি শিল্প। এই সম্প্রদায়েরা অন্যদের মতো করে শিক্ষালাভ করতে পারে; এটা তাদের অধিকার। শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে এই শিল্পকে অন্যের সামনে তুলে ধরতে হবে-এ উপলদ্ধি তাঁর। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে রিকু রাণী পাল সেটিকে শুধু নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেননি। এই আলোর বিচ্ছুরণ তাঁর সম্প্রদায়ের অন্যান্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে বড্ড প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তিনি। অবহেলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বোনার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘শিশু বিকাশ কেন্দ্র’। এই শিশু বিকাশ কেন্দ্র’র মাধ্যমে তিনি পাল পাড়ার শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার সুযোগ তৈরি করতে চান। পড়াশোনা এবং খেলাধূলা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই এই শিশুরা ভবিষ্যতে সমাজে তাদের স্থান তৈরি করে নিক-এই স্বপ্ন তাঁর।

বর্তমানে শিশু বিকাশ কেন্দ্রে ২৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। প্রতিদিন বিকালে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধূলা, বিনোদন, চিত্রাঙ্কনে তাদেরকে সহযোগিতা করছেন রিকু পাল। অভিভাবকরাও আগ্রহী হয়ে সহযোগিতা করছেন তাকে। পড়াশোনা, খেলাধুলার পাশাপাশি মাটি দিয়ে তারা মনের মতো গড়ে তুলে পরিবেশসম্মত আসবাবপত্র, সৌন্দর্য বর্ধণের জন্য নানা রকমের কারুকার্যের জিনিসপত্র। শিক্ষার্থীদের তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর। এ বয়স থেকেই শিশুরা যদি নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শিখে এবং সেটা প্রয়োগ করে তাহলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। তাই আনন্দচিত্তে শিশুরা তার কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করছে। তিনিও শিশুদের সঠিক পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পেরে গর্ববোধ করেন।

উল্লেখ্য যে, আটপাড়া বাকড়পুর গ্রামে ৩০টি কুমার পরিবারের ‘বাস’ রয়েছে। মাটির তৈজসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা। বাজারে প্লাস্টিক আসবাবপত্রের সহজলভ্যতার দরুণ কমে গেছে মাটির তৈরির আসবাবপত্রের চাহিদা। এর প্রভাব পড়েছে কুমার পরিবারগুলোর আয়ের ওপর। মাটির তৈরির আসবাবপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় কমে গেছে তাদের আয়-রোজগার। বর্তমানে স্বল্প আয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনমতে বেঁচে আছেন এই সম্প্রদায়। অনেকে ঐতিহ্যবাহী পেশা ছেড়ে এর মধ্যেই অন্য পেশার দিকে ঝুঁকেছেন। ফলশ্রুতিতে ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার বিষয়টি ভাববার আগে তাঁদেরকে ভাবতে হচ্ছে কিভাবে জীবিকা অর্জন করবেন! ছেলেমেয়েরা কোনরকমে নাম লিখতে পারলেই কিংবা যোগ-বিয়োগ অংক বুঝে নিলেই তাদেরকে অর্থ উপার্জন কাজের সাথে নিয়োজিত করেন তাঁরা।

এক্ষেত্রে রিকু রাণী পালের উদ্যোগটি তাদেরকে নতুন একটি স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম অনেক রিকু রাণী পাল আছেন যাঁরা নিজ উদ্যোগ ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মানুষের উপকার করে যাচ্ছেন; সমাজে স্থিতিশীলতা ও সঙ্গতি তৈরি করেছেন। আমরা রিকু পালসহ এসব উদ্যোগী, নিবেদিতপ্রাণ এবং নিঃস্বার্থ মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা জানাই। নিত্যদিনে আরও নতুন নতুন রিকু পাল জন্ম নিক আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিতে-এ প্রত্যাশা করি।

happy wheels 2

Comments