কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রকৃতির বিরূপ আচরণ
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
মানুষ খুবই আরামপ্রিয় প্রাণী। বিলাসবহুল জীবনযাপন ও পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলেছে। নিত্যনতুন আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানুষ কম সময়ে ও কম শ্রমশক্তি ব্যবহার করে অধিক পণ্য উৎপাদন করে অধিক মূনাফা লাভের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে কলকারখানা থেকে আরম্ভ করে কৃষির সকল ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে প্রচুর পরিমাণে কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ মিশে বায়ুমন্ডলের ওজন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রকৃতির উপর মানুষের এমন অবন্ধুত্বসূলভ আচরণের জবাব বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দিতে শুরু করেছে।
মধুপর গড় এলাকায় আনারস, আদা, কলা, পেঁপে, আম ইত্যাদি কৃষি ফসলের ব্যাপক চাষ হয়। পূর্বে মধুপুর এলাকায় এসব ফসল চাষ করতে কৃষকরা বন থেকে গজারীসহ বিভিন্ন গাছের পাতা সংগ্রহ করে ফসলে মালচিং করত এবং একান্ত প্রয়োজনে সামান্য পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করত। ১৯৮৯ সালে মধুপুর বনে এগ্রোফরেষ্ট্রি ও উডলট বন বাগান শুরু হলে বাগানের অংশীদার কৃষকরা রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু করে। বিশেষভাবে প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তিরা বন এলাকায় রাসায়নিক কৃষি উপকরণ দিয়ে বানিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদন করতে থাকে। এ সুযোগে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কৃষি উপকরণ/প্রযুক্তি উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান কৃষকদের নিকট হাজির হয় তাদের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে। কিছু কিছু কৃষি উপকরণ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অবৈধ পথে প্রবেশ করে, যেগুলো সেসব দেশে বিক্রয় নিষিদ্ধ। কৃষকরা কোম্পানির নজরকারা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে মানুষসহ সকল প্রাণী ও পরিবেশের উপর সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জেনে/না জেনে ব্যবহার করতে থাকে। রাসায়নিক এসব কৃষি উপকরণ কৃষকদের নিকট মেডিসির নামে পরিচিত (সার, কীটনাশক, হরমোন/ভিটামিন)। এগুলো ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও এগুলো মানুষসহ সকল প্রাণ ও পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
মধুপুর এলাকায় আনারস ও কলা ফসলে সবচেয়ে বেশি এসব কৃষি উপকরণ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে। আনারস ও কলার আকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, অসময়ে আনারস উৎপাদন ও ফলের রং সুন্দর করতে কৃষকরা এসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করছে। ফলে ভোক্তাগণ বঞ্চিত হচ্ছে সুস্বাদু ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের অধিকার থেকে। এসব বিষাক্ত ফল খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের জটিল রোগে। ২০০৪ সালে মধুপুরে রাসায়নিক উপায়ে চাষকৃত আনারস ও কলার খাদ্য নিরাপত্তা এবং বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহতা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারণা এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক এসব ফসল ধ্বংস করার খবর প্রচারের ফলে মধুপুরের আনারস ও কলার জনপ্রিয়তা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছিল। ভোক্তারা মধুপুরের আনারস ও কলা না কেনায় কৃষকরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মূখিন হয়েছিল।
কৃষকরা বেশ কয়েক বছর কৃষি ক্ষেত্রে বিষাক্ত রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার না করায় গত ৮-১০ বছর যাবত মধুপুরের আনারস ও কলা হারানো সেই ঐতিহ্য পুনরায় ফিরে পায়। সারা দেশে মধুপুরের আনারস ও কলার বেশ চাহিদা থাকায় অধিক মূনাফা লাভের জন্য কৃষকরা পুনরায় বিষাক্ত রাসায়নিক উপকরণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার আরম্ভ করে। কৃষকরা (অধিক মূনাফা লোভী) এখন আর জমিতে বনের পাতা দিয়ে মালচিং করেনা। শ্রমিক দিয়ে কৃষকরা আগাছা পরিষ্কার না করে এখন ঔষধ দিয়ে আগাছা মারছে। আনারস ও কলার আকার বড় করার জন্য হরমোন ব্যবহার করছে। কলা দাগমুক্ত করতে অতিমাত্রায় ১০-১৫ দিন পর পর কীটনাশক প্রয়োগ করছে।
মধুপুরের কৃষকরাও তাদের ব্যবহৃত রাসায়নিক কৃষি উপকরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানেন। তাই তারা নিজেদের খাওয়ার জন্য রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও হরমোনমুক্ত কলা ও আনারস চাষ করে। কিছুদিন আগে আমার এক আত্মীয়া ময়মনসিংহের বাসায় (ভাড়া বাসা) গিয়ে আনারস নিয়ে যায়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। আমি তাকে বলি যে, মধুপুরের আনারস ও কলায় প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক ব্যবহার করায় আমি খাইনা।” তখন ঐ আত্বীয়া আমাকে বলেন, “আমরা নিজেরা খাওয়ার জন্য বাগানের একটি অংশে (প্রয়োজন অনুযায়ী) কোন মেডিসিন (সার, কীটনাশক ও হরমোন) ব্যবহার করি না। এগুলো ব্যবহার না করায় আনারস পাকতে দেরী হচ্ছে। মেডিসিন মুক্ত আনারস ও কলা আকারে একটু ছোট হলেও খেতে মিষ্টি ও খুব সুস্বাদু।”
১৭ জুন ২০১৮ ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি কচু পাতা, পেঁপে পাতা, কলা পাতাসহ সকল গাছের পাতায় কাঁদা লাগার মত ফোটা ফোটা দাগ দেখতে পাই। দাগগুলো দেখতে কীটনাশক থিওভিট (ছত্রাক নাশক) স্প্রে করলে কলা পাতায় যে ধরণের দাগ হয় ঠিক সেই রকম। আমি এলাকার কৃষকদের কাছে জানতে চাইলাম, কেন তারা পেঁপে ও কচু গাছে কীটনাশক স্প্রে করেছে। উত্তরে কৃষকরা বলেন, “এটি কীটনাশক স্প্রে করার দাগ নয়। কিছুদিন আগে বৃষ্টি হয়েছিল, সেই বৃষ্টির পানিতে আঠাল জাতীয় পদার্থ মিশ্রিত ছিল। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগার পর আঠালো ও কাঁদার মত পদার্থ গাছের পাতায় ও মানুষের শরীর লেগে ছিল। সেই বৃষ্টির পর থেকে গ্রামের সকল গাছের পাতায় কীটনাশক স্প্রে করার মত দাগ লেগে আছে।” এ বিষয়ে কৃষক নির্মল খান ও শেখর ম্রং বলেন, “সম্ভবত এ অঞ্চলে কৃষকরা ফসল চাষ করতে গিয়ে যে পরিমাণে রাসায়নিক সার ও মেডিসিন ব্যবহার করেন, সেগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং বৃষ্টির পানির সাথে মিশে নিচে পড়ে, আর এতেই এই দাগের সৃষ্টি হয়েছে।”
প্রশাসনের উদ্যোগে এই মধুমাসে ভ্রাম্মমান আদালতের মাধ্যমে শহরাঞ্চলের ফলের বিভিন্ন আড়তে অভিযান চালিয়ে কার্বাড দিয়ে পাকানো আম ধ্বংশ করার সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সুবাদে জানা যায়। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বর্তমান মাসটিতে আমের পাশাপাশি কাঁঠাল ও আনারস ফলে বাজার ছেয়ে গেছে। মানুষের চোখ এখন এসব ফলের উপর। সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ এসব ফল কিনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মজা করে খাচ্ছে। কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন সকলের নিকট, আমরা আসলে কি খাচ্ছি ? আমের ন্যায় কাঁঠাল, অনারস ও কলা উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের উপর প্রশাসনের নজরদারী বাড়ানো জরুরি। কৃষি বিভাগের উদ্যোগে এসব ক্ষতিকর কৃষি উপকরণ বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভোক্তাদের নিরাপদ খাদ্য সুনিশ্চিত হয় এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষিত রেখে কৃষকরা চাষাবাদ করতে পারে। প্রকৃতিও এসব মরণনাশক পদার্থ থেকে রক্ষা পায়।