কৃষকের বন্ধু যুবক মোস্তফা হোসেন টিপন

নেত্রকনো থেকে মো. অহিদুর রহমান

ভাটিবাংলার দেশ নেত্রকোনা। নদী, হাওর, বিল, খাল, জলাভূমিতে মাছ, ধান জন্মায় সারাবছর। ধানের দেশ, গানের দেশ, ভাটির দেশ, বাউলের দেশ, শস্যফসলের বৈচিত্র্যে ভরা এই নেত্রকোনা। বন্যা, খরা, আফাল, ঢেউ, প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে ফসল ঘরে তুলে খাদ্যযোদ্ধারা। বর্তমানে বোরো মৌসুমে ধান কাটার শ্রমিকের অভাব হয়। ধান পাকলেও সময়মতো ঘরে তুলতে পারেনা শ্রমিকের অভাবে। বাংলাদেশের যুবরা দেশকে চিন্তায়, উদ্ভাবনে, উদ্যোগে দিনদিন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়াবার পাটাতনকে আরো মজবুত করছে বাংলার যুবকেরা। তেমনি একজন যুবক নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার মোস্তফা হোসেন টিপন। মদন উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকের সন্তান মোস্তফা হোসেন টিপন আলোড়ন তুলেছেন ধানকাটা মাড়াই ও ওড়ানোর আধুনিক যন্ত্র উদ্ভাবন করে।

মদন উপজেলার কাইটাইল ইউনিয়নের পাঁচহার বরবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই যুব কৃষি বিজ্ঞানী । বাবা মৃত আবদুল বারেক মিয়া ও মা জুবেদা আক্তারের ৫ সন্তানের মধ্যে টিপন তৃতীয়। টিপন প্রাইমারি স্কুল পারি দিতে পারে নাই। অভাবের সংসারে পড়াশুনা করতে পারে নাই। সংসারের হাল ধরতে ১৩ বছর বয়সেই আয় করার কাজে লেগে যায়। টানাপোড়েনের সংসার থাকায় উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর সেন্টারে প্রথমে মেশিন মেরামতের কাজ শুরু করেন। দোকানে রোজগার হতো কম। আয় বেশি না হওয়ায় একটি ওয়ার্কশপ দিয়ে কাজ শুরু করেন।

টিপনের মেশিন

টিপন ছোট বেলা থেকেই নতুন কিছু তৈরি করার নেশা ছিল। ছোটকালে কাঠ দিয়ে বাঁশ দিয়ে নতুন একটা কিছু আবিস্কার করতে চাইতো। উদ্ভাবক মোস্তফা হোসেন টিপন বলেন, ‘এলাকার অধিকাংশ মানুষেই কৃষক। তারা কীভাবে সহজে ধানকাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করতে পারে এসব চিন্তা করেই আমি মেশিনটি তৈরি করেছি। এ মেশিনটি তৈরি করতে আমার প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’ টিপনের তৈরি এ উদ্ভাবনী মেশিনটি ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিভাগীয় প্রধান আবদুর রহমান, প্রকৌশলী বিজ্ঞানী বিধান বাবু, প্রকৌশলী আকরাম হোসেন পরিদর্শন করেছেন।

ফতেপুর ইউনিয়নের হাসনপুর গ্রামের কৃষক আবু তালেব, তিয়শ্রী ইউনিয়নের কৃষক বাবুল মিয়া জানান, তাঁরা এ মেশিন দিয়ে ধানকাটা, মাড়াইয়ের কাজ সহজে এবং কম খরচে করতে পেরেছেন। শ্রমিক দিয়ে কাটলে এর চেয়ে দ্বিগুণ বেশি খরচ হতো। বালালী বাঘমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওয়াহিদুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘আমি নিজেইও তার উদ্ভাবনী মেশিনটি দেখেছি। এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। শ্রমিকের অভাব পূরণ করতে এই মেশিনটি কৃষকের উপকারে আসবে।’ উপজেলা কৃষি অফিসার গোলাম রসুল জানান, টিপনের উদ্ভাবনী কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার এ মেশিন দিয়ে ১ একর জমির ধান কাটতে মাত্র ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। যেখানে এ এলাকায় শ্রমিক দিয়ে ১ একর জমির ধান কাটতে লাগে ১০ হাজার টাকা। তার এ মেশিন দিয়ে প্রতিদিন ৫ একর জমির ধান কাটা সম্ভব।
হাওরের কৃষক ভিক্ষু মিয়া বলেন, ‘এই মেশিন আমাদের জন্য ভালো। বৈশাখ মাসে ধান পাকার পর ঘরে তোলার জন্য আমরা বেশি সময় পাইনা। আমাদের লক্ষ্য থাকে যত তাড়াতাড়ি পারি ধান লইয়া ঘরে উঠা। কারণ বন্যার ভয়ে সকল কৃষক দিন গুণতে থাকে।’ টিপন বলেন, ‘আমি চাই আমার এ আবিস্কারের স্বীকৃতি দেয়া হউক। মেশিনটি ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ এক সাথে করে বিধায় কৃষকের জন্য খুবই কউপকারী।’

এলাকার কৃষকেরা টিপনের এই উদ্ভাবনকে ভালোভাবে নিয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে গৌরিপুরের কেনু মিস্ত্রী, নেত্রকোনার কৃষক আ: হাইর মতো সে আরও নতুন নতুন কৃষি উপকরণ তৈরি করে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশকে জাতীয় ও অর্থনৈতিতে ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

happy wheels 2

Comments