শিব নদীতে সম্মিলিত উদ্যোগে তৈরি হবে ঝিনুকের অভয়াশ্রম
রাজশাহী থেকে অমৃত কৃমার সরকার
শিবনদী পাড়ের একটি গ্রাম কালিগঞ্জ। রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার দশ কিলোমিটার দক্ষিণে এই গ্রামটিতে কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি পাল সম্প্রদায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বসবাস। গ্রাম সংলগ্ন শিব নদীর এই অংশে সারাবছর পানি থাকার কারণে এখানে প্রচুর পরিমাণে ঝিনুক প্রাকৃতিকভাবে জন্মে যা স্থানীয় জনগোষ্ঠী নির্বিচারে সংগ্রহ করে হাঁস-মুরগির খাবার হিসাবে ব্যবহার করেন।
প্রাকৃতিক বাস্তুুতন্ত্র সুরক্ষায় ঝিনুকের ভূমিকা অপরিসীম। ধানের জমিতে ঝিনুকের ডিম ইঁদুর খায় বলে ধানের ক্ষতি কম হয়। এছাড়া প্রাকৃতিক ও দেশীয় মাছের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ঝিনুকের ডিম। ঝিনুক বর্ষাকালে আমন ধানের ব্যাপক উপকার করে। ঝিনুক পানি ফিল্টারিং করে প্রাকৃৃতিকভাবে পানিকে দূষণমুক্ত রাখে। কালিগঞ্জ গ্রামে ব্যাপকভাবে ঝিনুক নিধনের ফলে কৃষিজমিতে পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে, জমি হারাচ্ছে উর্বরতা আর পরিবেশ হারাচ্ছে স্বাভাবিক ভারসাম্য।
কালিগঞ্জ গ্রামে পাল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য বারসিক একটি গ্রাম সভা আয়োজন করে। ঝিনুক রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্টিকে সচেতন করার জন্য আয়োজিত এই সভায় কৃষক, নারী ও গ্রামবাসী অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। সভায় ঝিনুকের নানাবিধ উপকারী ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নেন শিব নদীর তাদের গ্রামের অংশকে ঝিনুকের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হবে। অন্য গ্রামের কেউ ঝিনুক সংগ্রহ করার জন্য কালিগঞ্জ গ্রামে এলে বুঝিয়ে ঝিনুক সংগ্রহ করা থেকে বিরত রাখা হবে। ঝিনুক সংগ্রহ না করার জন্য নদীর পাশে উপযুক্ত স্থানে সচেতনতা মূলক বিলবোর্ড স্থাপন করা হবে। গ্রামবাসীরা নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না। আর মাটির উপকরণ বানানোর জন্য নদীর নির্দিষ্ট যায়গা থেকে মাটি সংগ্রহ করবেন।
শিব নদী থেকে মাটি সংগ্রহ করে নানা ধরনের মাটির তৈজসপত্র বানানোর পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হাঁস পালন করেন শ্রীমতি মিনতী পাল (৪৫)। তিনি বলেন “আমাদের গ্রামের পাশে নদী থাকায় গ্রামের প্রায় সব নারীরাই হাঁস পালনের সাথে যুক্ত। আর এই নদী থেকে সারাবছর ঝিনুক সংগ্রহ করে হাঁসের খাবার হিসেবে আমরা ব্যবহার করি। আমরা জানতাম না যে, ঝিনুক জল ও পরিবেশের জন্য উপকারী। এ বিষয়ে কেউ কখনও আমাদের সাথে কথা বলেনি বা আলোচনাও করেনি।” তিনি জানান, নদীতে ঝিনুক বর্তমানে অনেক কমে গেছে। এই গ্রামের দ্বীজেন্দ্রনাথ পাল (৬৫) বলেন, “অতীতে আমাদের শিবনদীতে প্রচুর পরিমাণে ঝিনুক দেখা যেত, তখন নদীতে পঁচা কাদা ছিল না। ঝিনুক সব পঁচা কাদা খেয়ে নদীর তলদেশ পরিষ্কার রাখত। তখন নদীর পানিও পরিস্কার থাকত।” তিনি জানান, পাশের বিলকুমারী বিলের জমিতে ধান চাষে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে এখন বর্তমানে নদীতে ঝিনুক অনেক কমে গেছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “এখন ও যা ঝিনুক আছে এভাবে সংগ্রহ করলে ভবিষ্যতে তাও থাকবে না। কারণ গ্রামের নারীরা হাঁস-মুরগিকে খাওয়ানোর জন্য ছোট বড় সব ঝিনুকই সংগ্রহ করে থাকে।”
গ্রাম সভায় কালিগঞ্জ মৃৎশিল্পী সংগঠনের গ্রামবাসীরা তাদের সম্মিলিত সচেতনতায় শিব নদীর ঝিনুক শিকার বন্ধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।