“ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেললাইন’ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা

মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম

বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে রেলপথ উন্নয়নের জন্য আলাদাভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং সরকারি রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তর নামে দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান দু’টি আবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীন দু’টি সংস্থা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে নিরবিচ্ছিন্ন পরিবহন সেবা প্রদানসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পরিবহন করে আসছে। দেশের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৫ নভেম্বর ১৮৬২ তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত প্রথম ৫৩.১১ কি.মি: ব্রডগেজ রেল লাইন চালু করে।নিরাপদ, তুলনামূলক জ্বালানি সাশ্রয়ী, তুলনামূলক কম পরিবেশ দূষণ, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি কম এবং কম কার্বন নিঃসারক ও স্বল্প খরচে জনপ্রিয় এই পরিবহন মাধ্যমে সেবা প্রদানে বাংলাদেশ রেলওয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো যুগোপযোগী হলে এবং সারা দেশের প্রত্যেকটি জেলার সাথে নেটওয়ার্কিং থাকলে জনসাধারণের যাতায়াত সহজতর হবে এবং পরিবহন ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস পাবে। পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, শিল্পায়নের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং দারিদ্র্যতা হ্রাসসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে রেলওয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অর্šÍভুক্ত রেলওয়ে ক্যপাসিটি বৃদ্ধি এবং আধুনিকীকরণের কর্মসূচি রেলওয়ে উন্নয়নে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ১০টি প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হলো- ২০ বছর মেয়াদী রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যানে ২০১০-১১ অর্থ বছর হতে ২০২৯-৩০ অর্থবছর পর্যন্ত ২৩৩৯.৪৪ বিলিয়ন টাকা (ইউএস ডলার ৩০.০০ বিলিয়ন) ব্যয়ে মোট ২৩৫ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে এডিবি’র অর্থায়নে এটি সংশোধন ও পরিবর্তন হতে পারে।

7
বাংলাদেশ রেলওয়ের কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে যাত্রী সাধারণকে সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হচ্ছে না। বাংলাদেশে অর্šÍভুক্ত রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ব্রিটিশ উপনিবেশকাল ব্রিটিশ-ভারত রেলওয়ের অংশ হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশপ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বর্তমানে পরিবর্তিত ট্রাফিক ফ্লোর চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না। বর্তমানে ট্রাফিক চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে রাজধানীমূখী রেলওয়ে নেটওয়ার্ক স্থাপন বা পরিবর্তন, চট্রগ্রাম বন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে দূরত্ব কমানো এবং রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বহির্ভূত গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ সংযুক্ত করা প্রয়োজন।

ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেলপথ আন্দোলনের প্রসঙ্গিকতা
বাংলাদেশ সরকার ২০ বছর মেয়াদী মাস্টার প্ল্যান  (২০১০-২০৩০) এর আওতায় পর্যাক্রমে সকল জেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে রেলসংযোগের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সেই প্রেক্ষিতে মানিকগঞ্জবাসীর দাবি অযৌক্তিক নয়; বরং প্রাসঙ্গিক ও ন্যায়সঙ্গত। ভৌগলিক দিক হতে রাজধানীর নিকটবর্তী জেলা মানিকগঞ্জ এবং বৃহত্তর ঢাকা জেলার অন্তর্গত (১৯৮৪ সালের আগ পর্যন্ত মহুকুমা) বৃহত্তর ফরিদপুর ও টাঙ্গাইলের প্রতিবেশী জেলা, পদ্মা-যমুুুুনা বিধৌত এই জেলার চারদিকেই আছে রেল সংযোগ। তবুও মানিকগঞ্জবাসী এখনো রেল পথ থেকে বঞ্চিত। উল্লেখ্য, গত ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী রেলসংযোগসহ প্রথম পদ্মা সেতু হওয়ার কথা ছিল পাটুরিয়া-দৌলতিয়া। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দূরদর্শিতার অভাবে সেটি হয়নি। জনসাধারণ সূদীর্ঘকাল থেকে আশার বুক বেঁধে আছে ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেল লাইন ও নদীর ওপারের মানুষের প্রাণের দাবি রেল সংযোগসহ ২য় পদ্মাসেতু। এই দাবিগুলোকে শক্তিশালী করতে অবদান রেখেছে এই জনপদের সচেতন মানুষ। যতদূর জানা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকেই এই জনপদে তৎকালীন বামপন্থীরা রেলপথের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলন সংগঠিত করে। পাকিস্তান আমলে প্রথম রেলপথ ও রোড ডিভাইডারের জন্য প্রথম মানিকগঞ্জ মহুকুমা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন প্রখ্যাত কৃষক আন্দোলনের নেতা জ্ঞান চক্রবর্তীর নেতৃত্বে প্রমথ নন্দী, প্রমথ নাথ সরকার, সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, ডা. শামসুর রহমান, ডা. চিত্ত সাহা প্রমূখ (তথ্যসূত্র: ঢাকা জেলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস, জ্ঞান চক্রবর্তী)।

11
শিবালয় উপজেলার আরুয়া ইউনিয়নের নালী বাজারের সুধীর দাস বলেন, “আমরা ছোটবেলা থেকেই রেল লাইনের কথা শুনে আসছি। প্রমথনাথ সরকারের সাথে আরিচা ঘাটে পথসভায় কৃষকদের বিভিন্ন দাবি ও রেল লাইনের দাবির কথা শুনেছি।” আন্দোলন এর আরো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় ঘিওর উপজেলার গাংডুবি গ্রামের ক্ষেতমজুর নেতা কমরেড দুলাল বিশ্বাস এর কাছে। তিনি বলেন, “আমার কাছে একটি নকশা ছিল-সেটি হারিয়ে ফেলেছি। সেখানে ব্রিটিশ আমলের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়ায় পাতাল রেল ও স্থল পথের রেলের নকশা করা আছে। আমাদের সরকার পরবর্তীতে কি পরিকল্পনা করেছে সেটি জানি না তবে রেল লাইনের দাবিতে আন্দোলন করছি; যতদিন আছি করে যাব। আমি ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ঢাকা-মানিকগঞ্জ-আরিচা রেল লাইনের দাবিতে কৃষক ও ক্ষেতমজুর সমিতির উদ্যোগে স্মারক প্রদান করি।” তিনি আরো বলেন, “ঘিওর উপজেলার তখনকার চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন ভূইঞা কাছে যখন অনুলিপি ও বানিয়াজুরি-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দাবি নিয়ে কথা বলি; তখন তিনি আমাদেরকে পাগল বলেন এবং এগুলো কোনদিন হবে কিনা আমি জানি না। তবে আপনাদের উদ্যোগ ভালো। আমি এগুলো ফাইল নোট করব এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দেব।”

এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলন সংগ্রাম চলতে থাকে এবং একসময় সরকারের কানে পৌঁছায়। মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বিজয় মেলার মাঠে ১৯৯৭ সালের তৎকালীন সরকারের আমলে মানিকগঞ্জ সমিতি কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় জনসম্মুখে সর্বপ্রথম রেল লাইনের দাবির পক্ষে কথা বলেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড আজাহারুল ইসলাম আরজু। পরবর্তীতে করতালির মাধ্যমে জনসাধারণ সেটি গ্রহণ করে এবং আলোচকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেল লাইন ও রেল সংযোগসহ ২য় পদ্মাসেতু। এভাবে মানুষের মুখে মুখে রেল লাইনের এই দাবি আরো জোরালো হতে থাকে।

8
‘ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেল লাইন চাই’ এই দাবি জনগণের হলেও সচেতন মহলের দায় একটু বেশি। তাই এই দাবির পক্ষে সাংগঠনিক কোন কমিটি না থাকলেও যৌথভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে বারসিক ও মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব। প্রেস কøাবের সভাপতি গোলাম ছারোয়ার ছানু ও বারসিক এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারি বিমল রায় এর যৌথ স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চিঠি, স্মারকলিপি, দাবি সম্বলিত বিভিন্ন প্রচারপত্র, বিলবোর্ড এবং দাবিনামা নিয়ে মানববন্ধন, গণসংযোগসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ইতোমধ্যে জনসাধারণ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।
ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেল লাইন বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক গোলাম ছারোয়ার ছানু বলেন, “দাবিটি রাজনৈতিক হলেও সচেতন নাগরিক হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার আলোকে মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব ও বারসিক এই দাবির পক্ষে পৃষ্ঠপোষকতা করবে এবং সরকারের প্রতি গঠনমূলক চাপ প্রয়োগ করে দাবি আদায়ের কাজ অব্যাহত রাখবে। মনে রাখা দরকার যে, আমরা শুধু রেল লাইনের দাবি করছি। তাই ইতোমধ্যেই এই আন্দোলনে রাজনৈতিক দল ও সরকার প্রভাবিত হয়েছে বলে আমি মনে করি।”

ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেল লাইন বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব বিমল রায় বলেন, “আন্দোলনের আশার কথা হলো আমরা ইতেমধ্যে জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদের মাধ্যমে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সাথে ফলপ্রসু সংলাপ করেছি এবং তার মাধ্যমে এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে আলচনা হয়েছে। পাশাপাশি, রেল মন্ত্রণালয়ে স্মারক প্রদান ও মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে সংলাপ হয়েছে। প্রত্যেক দপ্তর থেকেই ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।”

পরিবেশবাদী আন্দোলনের সংগঠক এ্যাড. দিপক কুমার ঘোষ বলেন, “রেল লাইন চাই দাবিটি অতিমাত্রায় রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় হলেও বারসিক ও মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ইতোমধ্যে এই আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও সরকারকে প্রভাবিত করতে পেরেছে বলে আমি মনে করি।”
বানিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চতু বলেন, “মানুষের সংখ্যা বাড়ছে রাস্তায় জায়গা নেই। গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে না। আবার অনেকাংশে গাড়ি পার্কিং এর জায়গা নেই। এমতাবস্থায় এই সরকারের আমলেই রেল লাইনের কাজ শুরু করার জোর দাবি জানাই।”

বানিয়াজুরী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গিনী আলম বলেন, “এই রাস্তায় প্রচুর দুর্ঘটনা হয়েছে। রোড ডিভাইডারের ফলে দূর্ঘটনা কিছুটা কমেছে। কিন্তু জানজট বেড়েছে, যাত্রী বেড়েছে কয়েক গুণ। তাই এর সমাধান হতে পারে রেল লাইন। আমি আশা করি ২০২১ সালের মধ্যেই ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেল লাইনের কাজ শুরু হবে।”

জনগণের প্রয়োজনে জনগণের যৌক্তিক দাবি জনগণের চাপে সরকার সেটি নিশ্চয়ই করবে বলে মাকিগঞ্জবাসী আশা প্রকাশ করে। ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রেললাইন বাস্তবায়ন করতে হলে সচেতন মহলকে আরো সোচ্চার হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ধারায় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই প্রভাবিত করতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়িত্ব নিতে হবে। গ্রামে-গঞ্জে, স্কুল-কলেজে, হাট-বাজারে এই গণ দাবির পক্ষে আরো জনমত সৃষ্টি করে আন্দোলনের চূড়ান্ত ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে।

happy wheels 2

Comments