দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে একটু একটু করে বড় হওয়া সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম

ছোট একটি টিম এখন অনেক বড়। ৩০ সদস্যের সুন্দরবন স্টুডেন্টস সলিডরিটি টিম বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ৩শ’ ছাড়িয়েছে। বর্তমানে শ্যামনগর উপজেলা সদরে একটি সমন্বয় কমিটি ও কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষি জমি রক্ষা, প্রাকৃতিক সম্পদে অধিকার প্রতিষ্ঠা, ভেড়ি বাঁধ সুরক্ষা, বাল্য বিবাহ রোধ, দরিদ্র্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহযোগিতা, পরিবেশ উপযোগী বনায়ন ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠে স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম। সামাজিক, প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন ও প্রতিবেশীয় সম্পর্ক উন্নয়নে স্বেচ্ছাশ্রমে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করে চলেছে তারা। নিজেদের কাজ এবং কাজের অভিজ্ঞতা সহভাগিতার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে টিমে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করা সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্বেচ্ছাশ্রমে সেবামূলক ও উন্নয়ন কাজের আলোয় আলোকিত হয়ে স্কুল, কলেজের আগ্রহী আরো শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহন বাড়তে থাকে টিমে। ফলে টিমের কার্যক্রম আরো সুষ্ঠুভাবে যাতে বাস্তবায়িত ও পরিচালিত হতে পারে তার জন্য সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম ছোট ছোট ৬টি ইউনিটে ভাগ হয়ে নিজ নিজ এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করে সে সমস্যা সমাধানে সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরীর মাধ্যমে কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। তার একটি দৃষ্টান্ত সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের যাদবপুর ইউনিট।

বর্তমান গল্পটি একটু একটু করে বড় হওয়ার দিকে ধাবিত হওয়া সেই টিমের একটি অংশ যাদবপুর ইউনিটের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে লেখাটি তৈরি করেছে সাতক্ষীরা শ্যামনগর এর জেসমিন আরা ও বিশ্বজিৎ মন্ডল

দৃষ্টান্ত : ০১
শ্যামনগর উপজেলায় প্রায় সবখানে পানির সংকট বিশেষত খাবার পানির তীব্র সংকট বিদ্যমান। ভৌগলিক অবস্থানগত ভিন্নতার কারণে এখানকার ভূগর্ভস্থ পানি অর্থাৎ মাটির নিচের পানি লবণ প্রকৃতির। ফলে এখানকার মানুষ অনেক বেশি ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। পানি সংকট মোকাবেলায় তাই এখানকার মানুষ অবলম্বন করে নানান কৌশল। প্রায় দুইশ বছর আগে সদানন্দ বাবু নামে একজন ব্যক্তি উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার যাদবপুর গ্রামে বসতি গড়ে তোলে। তিনি এলাকার মানুষের পানি চাহিদার কথা বিবেচনা করে নিজস্ব ১ একর ৪২ শতক জায়গায় একটি পুকুর খনন করেন। শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর জনসাধারণের স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করে ১৯৯২ সালে পুকুর পাশে পিএসএফ তৈরী করে দেয়। ১১ জন মালিকানাধীন এই পুকুর পাড়ে সরকারীভাবে ফিল্টারটি নির্মাণ করা হলেও বেশ কিছু দিন পর সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ফিল্টারটি নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে  গ্রামের মানুষ আবারও সুপেয় পানির সমস্যায় পড়ে। এলাকার মানুষের পানির চাহিদা বিবেচনা করে বিগত ২০১৩ সাল থেকে সুন্দরবন স্টুডেন্টস সলিডারিটি টিমের যাদবপুর ইউনিটের সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে পুকুর ও পিএসএফ সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহন করে। এছাড়াও এর পাশাপাশি পাশের পশ্চিম মাহমুদপুর গ্রামের দীর্ঘদিন অকেজো থাকা ফিল্টার ও এক একর আয়তনের পুকুরও পুনরায় সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করে। সরকারী বেসরকারী সংস্থার সহায়তায় ২০১২ সালে পুকুরটি পূন:খনন ও নতুন ফিল্টার তৈরী করে। ফিল্টারগুলো সচল হওয়ায় আশেপাশের ৮ গ্রামের মানুষ নিজেদের পানি চাহিদা পূরনে সক্ষম হচ্ছে। পানি ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টিতে যাদবপুর ইউনিট পুকুর পাড়ে আলোচনা সভা ও কলসের মুখে প্লাস্টিকের ঢাকনা ব্যবহারে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে যাদবপুর ইউনিট। এছাড়াও স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম স্বেচ্ছশ্রমে গ্রাম থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও বারসিকের সহযোগিতায় পুকুরটি সংরক্ষনে চারিপাশে নেট জাল দিয়ে ঘিরে দেয় এবং পুকুর পাড়ে টিউবওয়েল স্থাপন করে যাতে পুকুরের পাশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী গৃহস্থলীর কাজে পুকুরটি ব্যবহার না করে টিউবওয়েল ব্যবহারের মাধ্যমে গৃহস্থলির কাজগুলো সম্পাদন করতে পারে। এছাড়াও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে পুকুর ব্যবস্থাপনায় সার্বিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে।

দৃষ্টান্ত: ০২
গ্রামের মানুষের পানি সংগ্রহের সুবিধার্থে রাস্তা সংস্কারের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে তারা। যাদবপুর ইউনিটের সদস্যরা রাস্তা সংস্কারে করনীয় বিষয়ে আলোচনা করে স্থানীয় ইউপি বরাবর পথটি পাকা করনে আবেদন জানায়। আবেদনের প্রেক্ষিতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে রাস্তা সংস্কারে ১০০০ ইট বরাদ্দ করে। বারসিক সহযোগিতায় ইট পরিবহন ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রাস্তায় ইট বিছিয়ে সব মৌসুমে পানি সংগ্রহের উপযোগি করে তোলে ইউনিটটি। যাতে মানুষ নির্বিঘেœ পানি সংগ্রহের মাধ্যমে নিজেদের দৈনন্দিন পানি চাহিদা মেটাতে পারে। এভাবে প্রতিনিয়ত এলাকার মানুষের পানি চাহিদা পূরনে ভূমিকা রাখছে স্বেচ্ছাসেবী এই যুব দল।

দৃষ্টান্ত: ০৩
বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ এদেশের জালের মতো নদী চারি দিকে ঘিরে রেখেছে। আর বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে নদীর প্রাবল্য বেশি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ‘মাদার’ নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় এলাকাতে কৃষি সহ মৎস্য ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির সংকট সৃষ্টি হয়। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে বীজ তলা তৈরী ও ধান চাষে ক্ষতিগ্রস্থ হয় স্থানীয় কৃষকেরা। উক্ত সংকট মোকাবেলায় স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম মাদার নদী পুন:খনন বিষয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ ও আলোচনার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে। এছাড়া মাদার নদী কূলবর্তী  স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটিকে সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মাদার নদী পুন:খননের দাবি জানায়।

দৃষ্টান্ত: ০৪
শ্যামনগর উপজেলার যাদবপুর বিলের মোট ১১শ বিঘা কৃষি জমি। এলাকার কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি দীর্ঘ ১০ বছর যাবত চিংড়ি চাষের নীতিমালা না মেনে ঘের করছে। তাদের চিংড়ি ঘেরের কারনে ধীরে ধীরে চিংড়ি ঘেরের পাশের কৃষি জমিতে ধান চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ ও আলোচনা করা হলেও কোন কৃষি জমি রক্ষায় কোন সুরাহা পায়নি কৃষকেরা। ফলে একপর্যায়ে কৃষি জমি রক্ষায় গ্রামের কৃষকেরা আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। কৃষি জমি রক্ষায় কৃষকদের এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের স্থানীয় ইউনিট সদস্যরা। গ্রামের কৃষক, সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম, উপজেলা জনসংগঠন, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও বারসিকের সহায়তায় কৃষি জমি রক্ষায় মানববন্ধন করে কৃষি জমি রক্ষা ও চিংড়ি নীতিমালা মেনে চিংড়ি চাষের দাবি তুলে ধরে। এছাড়া কৃষকদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরনের দাবি করে। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও তদন্তের প্রেক্ষিতে চিংড়ি ঘেরের পাশে আউট ড্রেন তৈরী হয়, লবণ পানির হাত থেকে রক্ষা পায় শত শত বিঘা কৃষি জমি। ধান ছাড়াও অন্যান্য ফসল চাষের সুযোগ তৈরী হয়। লবণ পানির অনুপ্রবেশ জনিত সমস্যা সমাধানে স্টুডেন্টস সলিডারিটি টিম, উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটি ও বারসিক এর সহযোগিতায় ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে লবণ পানির অনুপ্রবেশ থেকে কৃষি জমি রক্ষায় মানববন্ধন আয়োজন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্টুডেন্টস টিমের ধারাবাহিক কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক পর্যায়ে বিষয়টি প্রশাসনের সুনজরে আসে কৃষি জমি রক্ষায় চিংড়ি চাষের নীতিমালা মেনে চিংড়ি চাষের নির্দেশ প্রদান করেন।

দৃষ্টান্ত: ০৫
কালমেঘা গ্রাম ও কল্যানপুর গ্রাম সংলগ্ন কল্যানপুর খাল পারাপারে একটি সাঁকো দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খালপাড়ে বসবাস করা পরিবারের শিক্ষার্থী ও গ্রামের নারী-পুরুষেরা স্কুলে যাতায়াত ও পানি সংগ্রহের কাজে এই সাঁকোটি ব্যবহার করে। বলা যায় সাঁকোটি যোগাযোগের সংক্ষিপ্ত পথ দুই পারের মানুষের। তা না হলে ২.৫ কিলোমিটার বেশি হাটতে হয়। এ সাঁকোটি অনেকদিন যাবৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় চরম দূর্ভোগ হয়ে দাড়ায় স্কুলগামী শিক্ষার্থী, পানি সংগ্রহকারী ও পথচারীদের জন্য। পূর্বে সাঁকোটি নষ্ট হলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করে মেরামত করলেও এবার আর সম্ভব না হওয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী কালমেঘা কৃষক সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে। স্টুডেন্ট টিম কৃষক সংগঠনের সদস্যদের সাথে নিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে সাঁকো মেরামত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সকলের সম্মিলিত সহযোগীতায় নির্মিত সাঁকোটি আবার নতুন করে পারাপরের উপযোগী হয়।

দৃষ্টান্ত: ০৬
গ্রামের একজন প্রবীন নারী আমেনা বেগম। মানসিক ভারসাম্যহীন এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং মেয়ের ২টি সন্তান নিয়ে তার সংসার। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বলতে ঐ বৃদ্ধা মা-ই সব। পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা পূরনে অন্যের বাড়িতে নিজেকে শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়। বৃদ্ধ মায়ের ঐ পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরনে তাই স্টুডেন্ট টিমের যাদবপুর ইউনিট ভিজিডি কার্ড পেতে সহায়তা করে। শীতের সময় শীত বস্ত্র সংগ্রহে সহায়তা করে। এছাড়া স্বাস্থ্য ঐ পরিবারের স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে স্যানিটেশন নিশ্চিত করে। নিজেদের জমানো টাকা এবং জনগোষ্ঠীর সহযোগীতায় আমেনা বেগমের স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়।

স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের যাদবপুর ইউনিট নিজ উদ্যোগে, কখনো স্বেচ্ছাশ্রমে, কখনো বা সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে এলাকার কৃষি ও বৈচিত্র্য রক্ষা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

happy wheels 2

Comments