সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় হাওরের প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়বে
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল:
আমাদের জলাভূমি, জলাভূমি অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, পেশাজীবী জনগণ, উন্নয়নের রূপ বদলাচ্ছে। জলাভূমি ব্যবস্থাপনায় অনেক দুর্নীতি ও বাধা আছে। প্রকৃত পেশাজীবী জেলেরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দিনদিন প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ ও বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। কেবলমাত্র ধনীদের কাছে বিল ইজারা দেয়া বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত মৎস্যজীবীর নামে অপ্রকৃত মৎস্যজীবীর মাধ্যমে জলাভূমি ও মৎস্য সম্পদ নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় হাওরের প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়বে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বক্তারা।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক কর্তৃক আয়োজিত হাওরের ইজারা প্রথা ও মৎস্য ব্যবস্থাপনা শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় সভা প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, জেলেসহ হাওরাঞ্চলের মানুষের কথা আমাদের বেশি বেশি শোনা দরকার। হাওরের প্রকৃত অবস্থাটি হৃদয় দিয়ে অনুভব করা দরকার। যত বেশি আমরা আলোচনা করবো তত বেশি জলাভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য উপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারবো।”
পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও গবেষক পাভেল পার্থের সঞ্চাচলায় গোলটেবিলে আলোচনা করেন সাবেক সাংসদ ও কৃষকনেতা ছবি বিশ^াস, মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক কাজী শামস আফরোজ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক নেতা কুদ্দস আফরাদ, বিআইডব্লিউটি এর সাবেক পরিচালক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন, হাওর গবেষক হালিম দাদ খান, পবা’র সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, এ্যাড সুব্রত চৌধুরী, মেনন চৌধুরী, শাহরিয়ার চৌধুরী বিপ্লব, নেত্রকোনায় জানমা মৎস্যজীবী সমিতির নেতা যোগেশ চন্দ্র বর্মণ প্রমূখ। গোলটেবিল আলোচনায় ধারণাপত্র উত্থাপন করেন বারসিকের পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস।
গোলটেবিলে বক্তারা মৎস্য সম্পদ বাঁচাতে কৃষিখেতে রাসায়নিকের ব্যবস্থা বন্ধ করতেও আহবান জানান। হাওরাঞ্চলের বোমা মেশিন, অবৈধ বালু উত্তোলন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো, উজানে অপরিকল্পিত খনন বন্ধের আহবান জানান। তারা আরো বলেন, প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন কমলেও চাষের মাছ কিন্তু বেড়েছে। কিন্তু সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার দ্বারা মাছের পোনা না ছেড়েও প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
বক্তারা আরো বলেন, প্রাকৃতিক উৎস এবং প্রাকৃতিক সম্পদগুলো নিদারুণভাবে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়। দু:খনজকভাবে দেশের বৈচিত্র্যময় জলাভূমিগুলো তাদের নাম-পরিচয় এবং বিশেষ বাস্তুসংস্থানের ধরন হারিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জলমহাল’ হিসেবে পরিচিত হতে থাকে বা পরিচয় করানো হয়। আর এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনাগত দৃষ্টিভঙ্গি হলো সেই জলাভূমিতে বাজার নির্ভর মৎস্যজাত পণ্যের হিসাব-নিকাশ। আর তাই জলাভূমির সাথে জড়িত স্থানীয় পেশাজীবী জনগণ থেকে শুরু করে চারপাশের বৈচিত্র্যময় সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করে জলাভূমিকে দেখা হয় মূলত বাণিজ্যকভাবে মাছচাষের জায়গা হিসেবে, যেন এগুলো এক বৃহৎ কোনো মৎস্যখামার। বেসরকারি সংগঠন আইইউসিএনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়: দেশের ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছ চরম বিপন্ন, ২৮ প্রজাতির মাছ বিপন্ন ও ১৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এই প্রতিবেদন থেকেই দেশের মিঠা পানির মাছ বৈচিত্র্য পরিস্থিতি অনুমান করা যায়। জলাভূমি নিয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। হাওরাঞ্চলের জলাভূমিগুলির প্রতিটির বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং এর সাথে হাওরবাসীর নানাবিধ সম্পর্ক আছে। একে কেবলমাত্র জলাভূমি ব্যবস্থাপনার নামে ধনী ও প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিয়ে বৃহৎ মৎস্যখামারে পরিণত করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে।
বর্তমান সরকার মৎস্যজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মৎস্যজীবীদের পরিচয়পত্র তথা মৎস্যজীবী কার্ড প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যেন প্রকৃত মৎস্যজীবীরা জলমহালসহ সরকারী সুযোগ সুবিধায় তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। মৎস্যজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী এই উদ্যোগটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১১ সালে বারসিকের প্রাকৃতিক মাছের বৈচিত্র্য ও পরিমান কমে যাওয়ার ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর রাজস্ব আয়ের এক বড় অংশই ব্যয় করতে হচ্ছে। বিল নার্সারি, অভয় আশ্রম, মাছের পোনা অবমুক্তকরণের নামে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও প্রশাসন নির্ভর বাস্তবায়ন করতে সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সেই অর্থ যদি জলমহাল সংস্কার ও জেলেসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় করা হয়, তবে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক মাছ বৈচিত্র্যবাড়বে, সংরক্ষিত হবে প্রাকৃতিক জলমহাল অন্যদিকে দেশের হতদারিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে আসবে। গোলটেবিল থেকে জলমহাল ইজারা প্রথা বাতিলসহ প্রকৃত মৎস্যজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়। প্রধান অতিথি মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু এমপি হাওরবাসীদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।