গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রাম: জননেতৃত্বে সবুজ উন্নয়ন

নেত্রকোনা থেকে রনি খান

“মাটির উপর জলের বসতি, জলের উপর ঢেউ
ঢেউয়ের সাথে পবনের পিরিতি, নগরে জানে না কেউ”

বর্ষায় থৈ থৈ রূপালী জলের সর্পিল ঢেউয়ে চোখ পড়লে মনে হবে এ যেনো অথৈ সায়র! এর না আছে কোন থৈ, না আছে কোন কূল! দিগন্ত বিস্তৃত ঝিলমিল ঢেউয়ের দিকে তাকালে মনে হবে-এখানে আকাশ এসে মিশে গেছে জলের সাথে। দৃষ্টি সীমার কোথাওবা যদি হঠাৎ কোন গ্রাম চোখে পড়ে, মনে হবে এ যেনো এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ। মনে হবে ‘কূল নাই দরিয়ার পাড়ে, বৃক্ষ একটা মনোহর’! বলছি হাওরের কথা। ‘হাওর’- যে ভূমি ছয় মাস থাকে জলে থৈ থৈ সাগর, আর বাকী ছয় মাস দিগন্তখোলা সবুজ প্রান্তর। হাওর নিয়ে বাংলাদেশের নানা সময়ে নানা গবেষণা হয়েছে, হয়েছে নানা তর্ক-বিতর্ক, হাওরের বুক ছিঁড়ে বয়ে যাওয়া নদীর বুকে বাঁধ হয়েছে, উপরে সেতু হয়েছে, হাওরের বুকজুড়ে হয়েছে ‘অজগরের মতো মস্ত সড়ক’। এক কথায় কয়েক দশকে হাওরের বুকে হয়েছে অভাবনীয় উন্নয়ন।

তবে এখনো হাওরের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। বরং কিছু কিছু জায়গায় হয়েছে আগের চেয়েও জটিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম অভিঘাত। আমাদের রাষ্ট্রীয় সামাজিক শ্রেণি কাঠামো মতে, হাওর পাড়ের বেশিরভাগ মানুষই হয়তো হবেন ‘নি¤œ আয়ের’ মানুষ। অন্যকথায় বললে ‘প্রান্তিক’। উন্নয়ন কাঠামোর হিসাবে এই ‘প্রান্তিক’দেরও ‘প্রান্তিক’ (চড়ড়ৎবংঃ ড়ভ ঃযব চড়ড়ৎ) যারা তারাই হয়তো হাওরের ভূমিহীনরা। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই ভূমিহীনদের জন্যই গ্রহণ করেছেন ‘আশ্রয়ন প্রকল্প।’ তাদের বাসস্থানের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন ‘গুচ্ছগ্রাম’। রূপালী হাওরের গভীর বুকে গড়ে উঠেছে এমন বেশ কয়েকটি গুচ্ছগ্রাম। যার একটি নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রাম। এই লেখাটিতে আমরা মদন উপজেলার বন্দের হাওরের গভীর বুকে জেগে উঠা গুচ্ছগ্রামের মানুষের কথা জানতে চেয়েছি। গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের জবানী থেকে আমরা বুঝতে চেয়েছি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হুসেন মিয়া’র দ্বীপ এর সাথে আমাদের এই গুচ্ছগ্রামের মাইনুল হকদের কি আদৌ কোন সাদৃশ্য আছে? আমরা বুঝতে চেয়েছি গভীর হাওরের বুকে তৈরি করা একটি গ্রাম কীভাবে টিকে আছে? আমরা বুঝতে চেয়েছি সেই গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের স্বপ্ন, স্বপ্নজয়ের লড়াই ও বাস্তবতার কথা।


২০১৯ সালে গুচ্ছগ্রামের পাশের গ্রাম গোবিন্দশ্রী থেকে মাইনুল হক তার পরিবার নিয়ে বসবাস করতে এখানে আসেন। তার মতোই আরো আসেন রিক্তা মনি, রেখা আক্তারের পরিবার সহ আরো ৪৭টি পরিবার। সরকারিভাবে তৈরি করা টিন শেডের ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে থিতু হন তারা। ৫০টি পরিবারের জন্য একটি টিউব ওয়েল, একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ মোট ৫০টি টিনশেড ঘর তৈরি করে দেয়া হয়। এই প্রতিবেদন লিখতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামবাসী নিজ উদ্যোগে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন।


বাংলাদেশের অন্য যে কোন গুচ্ছগ্রাম বা আশ্রয়ন প্রকল্পের সাথে হাওরাঞ্চলের গুচ্ছগ্রামের একটি মৌলিক ব্যবধান রয়েছে। যেহেতু এই গুচ্ছগ্রামগুলো হাওরের গভীরে, সেহেতু এই গুচ্ছগ্রামগুলোকে মোকাবেলা করতে হয় হাওরের ‘আফাল’। ‘আফাল’ মানে হাওরের ঢেউ যা বর্ষা মৌসুমে অহর্নিশ আঁচড়ে পড়ে হাওরের গ্রামগুলোতে। হাওরের ‘স্বাভাবিক’ ভৌগলিক অবস্থানে যে গ্রামগুলো হাওরের কিনারায় সেগুলোকে এই আফাল খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে না। কিন্তু যে স্থাপনাগুলো হাওরের স্বাভাবিক পানির ¯্রােত ও ঢেউয়ের প্রতিকূলে তৈরি করা হয় সেগুলো হয় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই আফাল প্রায় প্রতিবছরই গ্রামের বাড়ি ভাঙন, ফসল রক্ষা বাঁধ ভাঙন ও ভূমিক্ষয়ের বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনও দেখা যায়, স্কুলের পাঠদান, মসজিদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হয় এমনকি মানুষজনকে বাড়ি-ঘর ছেড়েও চলে যেতে হয়। এখানেই অন্যান্য আশ্রয়ন প্রকল্পগুলোর সাথে গভীর হাওরের আশ্রয়ন প্রকল্পের মূল ব্যবধান।
এবার ফিরে যাওয়া যাক গোবিন্দশ্রী গুচ্ছ গ্রামের মাইনুল হকদের কাছে। ২০১৯ সালে মাইনুল হকরা যখন এ গ্রামে আসেন, তখন গ্রামটি শুধুই কিছু টিনশেড ঘরের একটি অবকাঠামো। একদিকে কড়া রোদ, অন্যদিকে আফাল। মৃত মাটির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছিলো গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতেই গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রামে কাজ শুরু করে বেসরকারি গবেষণা উন্নয়ন সংস্থা বারসিক। স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি/সংগঠনকে সাথে নিয়ে বারসিক সেখানে বৈচিত্র্যময় ও পানি সহনশীল বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ নেয়। আফাল থেকে বাঁচতে গ্রামের চারপাশে তৈরি করে সবুজ নিরাপত্তা বেষ্টনি। ২০২০ সালের বন্যা পরবর্তী সময়ে ৫০০টি হিজল করচ এবং ৩০০০ মূর্তা বেত, বিন্নাচুবা এবং ঢোলকলমি রোপন করা হয়। বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি এলাকা উপযোগী ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র্যময় ১৭টি জাতের সবজি বীজ বিতরণ করা হয়। বস্তা পদ্ধতি, টাওয়ার পদ্ধতি ও মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করা হয় গুচ্ছগ্রামবাসীকে। শুধুমাত্র শাকসব্জি চায় নয় হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলসহ গবাদিপশু পালনে উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদান করে বারসিক। এই গুচ্ছগ্রামটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানা সময়ে কখনো বৃক্ষরোপণ, কখনো ভ্যাক্সিনেসন ক্যাম্প, কখনো বীজ বিনিময় প্রভৃতি নানাভাবে বারসিক প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করে আসছে। এভাবেই বারসিক’র পরামর্শ ও সহযোগিতায় মদনের গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রাম এখন ‘সবুজ গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত।


২০২৪ সালে এই প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরের সামনে রয়েছে পারিবারিক সব্জিবাগান, রয়েছে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলসহ বৈচিত্র্যময় আয়ের উৎস। এই গ্রামে আসার প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে গিয়ে রেখা আক্তার বলেন, ‘হইলা হইলা যে বেলা আইছি, খালি গরম লাগদো। ঘরও গরম, বাইরেও গরম। অহন মাশআল্লাহ গাছ-গাছালি অইছে। গাছে ছ্যামা দেয়, ফলও খাইতাম ফারি। হাগ-বারতাও করি, কিশশি করি। অহন আগের চেয়ে ভালা আছি।’ গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রামে এখন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। ফলে আক্ষরিক অর্থেই ভালো আছেন তাঁরা।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনো কিছু উন্নয়নের ক্ষেত্র রয়েছে সেখানে। যেমন প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রটি আরো কার্যকর করা আবশ্যক। আফাল থেকে রক্ষার জন্য আরো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া দরকার। প্রতিবছর মাটি কেটে গুচ্ছগ্রামটি উঁচু করার কারণে, ঘরের ভিটেগুলো নিচু হয়ে গেছে। এ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য সহযোগিতার প্রত্যাশা করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

happy wheels 2

Comments