শ্যামনগরের লবণাক্ততার প্রভাবে ধ্বংসের পথে ঐতিহাসিক স্থান
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে গাজী আল ইমরান
উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে লবণাক্ততা। এর প্রভাব মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দূর্বীসহ করে তুলেছে। অধিক মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় এলাকায় একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, কৃষি, এলাকার অবকাঠামোসহ একাধিক বিষয়ের উপর রয়েছে লবণাক্ততার প্রভাব। অবকাঠামোগত প্রভাবের মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঐতিহাসিক স্থানগুলোর উপর এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মকভাবে। শ্যামনগরে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক স্থান। স্থানগুলো ঐতিহাসিক নিদর্শন বহন করে চললেও লবণাক্ততা এবং সংষ্কারের অভাবে তা আজ বিলীন হতে চলেছে। উপজেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরীপুর ঐতিহাসিক যশোরেশ্বরী কালী মন্দির। কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটি ধারণা করা হয় যে “আনারি” নামের এক ব্রাহ্মণ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে এবং তিনি এই যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠের ১০০টি দরজা নির্মাণ করেন বলেও ধারণা করা হয়। কিন্তু মন্দিরটি কত সাল নাগাদ নির্মিত হয় তা আজও জানা যায়নি। পরবর্তীকালে ল²ণ সেন ও রাজা প্রতাপাদিত্য কর্তৃক তাদের রাজত্বকালে এটির সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু লবণাক্ততার প্রভাবে একদিকে যেমন স্থানটি কিছুটা হলেও ধ্বংসের পথে অন্যদিকে প্রভাবশালী ভুমিদস্যুরা জাল দলিল সৃষ্টি করে মন্দিরের জমি দখল করে ভোগদখল করছে এমনটা অভিযোগ রয়েছে অনেকের। মন্দিরের ইটের দেওয়াল খসে পড়ছে লবণাক্ততার ও সংষ্কারের অভাবে।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/10/IMG_2467-1024x682.jpg)
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মদির আগমন উপলক্ষে মন্দিরটিতে কিছু সংষ্কার করা হলেও ঐতিহ্য বহন করা ত্রিকোন মন্দিরসহ সামনের অংশ রয়েছে একেবারেই অরক্ষিত। মন্দিরটির সামনের অংশ দেখলেই বোঝা যায় লবণাক্ততার প্রভাব কতটুকু পড়েছে মন্দিরটিতে। প্রাচীন কালের কালের সাক্ষী মন্দিরটির ছোট ছোট নিখুত ইটগুলো লবণের মতো হয়েই ঝরে ঝরে পড়ছে।
ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরীপুর টেঙ্গা মসজিদ অর্থাৎ বংশিপুর শাহী জামে মসজিদ। জানা যায়, পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদ ১৫৯৯ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়। মসজিদটি দীর্ঘদিন উন্নয়নের ছোঁয়া না লাগায় লবণাক্ততার ফলে হুমকির মুখে পড়তে থাকে। বিভিন্ন অনুদান এবং এলাবাসীর প্রচেষ্টায় বর্তমানে সংষ্কার করা হয়েছে এবং টাইলস দিয়ে সংস্কার করায় কিছুটা হলেও লবণাক্ততার প্রভাব কমেছে বলে মনে করেন অনেকেই।
ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নাম বহন করা আর এক বাহক শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের খানপুর গ্রামে অবস্থিত প্রতাপাদিত্যের জাহাজ ঘাটা নৌদূগ নামক স্থান। ইতিহাস মতে, যমুনা-ইছামতি নদীর পূর্বপাড়ে এই জাহাজঘাটার রণতরী তৈরি ও মেরামতের কাজ হতো। জাহাজঘাটার একটি মাত্র ভবন ভেঙ্গে-চুরে এখনও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। শুরু হয়েছে চুন সুড়কি খসে পড়া। ঐতিহাসিক নাম বহন করা স্থানটি দেখলে বোঝা যায় এই এলাকায় লবণাক্তার প্রভাব কতটুকু। লবণাক্ততার প্রভাবে ইটের গায়ে লবণের দাদার মতো পড়েছে অন্যান্য স্থাপনার ন্যায়। সাধারণভাবে দেখলেই হয়তোবা অনেকেই বুঝতেই পারবেনা যে লবণাক্ততার কারণে ভবনটি ধ্বংস হতে চলেছে!
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/10/Jahajghata-1024x521.jpg)
ঐতিহাসিক স্থানের মধ্যে রয়েছে হাবসি খানা বা হাম্মামখানা।এটি দেখতে একটি অট্রালিকার মতো। তবে এটি লোকমুখে হাবসিখানা নামে পরিচিত। অট্টালিকার পাশে একটি ক‚প থাকায় লোকে ধারণা করে যে এখানে বন্দীদের আটক রাখা হতো। তবে এখানকার মানুষের অনেকের ভাষ্যমতে, এটি রাজা প্রতাপাদিত্যের অতিথিশালার অংশবিশেষ। ¯œানাগার বা হাম্মামখানা যা ষোল শতকের শেষ দিকে নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে চৌবাচ্চা এবং পানি চলাচলের পথ রয়েছে। ছাদে বড় বড় ছিদ্রওয়ালা গম্বুজ দিয়ে খুব সহজে আলো বাতাস এই ¯েøানাগারে প্রবেশ করতে পারে। অট্রালিকার মতো দেখতে স্থাপনাটি চারদিকের দেয়ালে সুড়কির ন্যায় গুড়া খসে খসে পড়তে দেখা যায়। সংস্কারের অভাব, অপরিচর্যা ও অবহেলা এবং সর্বোপরি লবণাক্ততার গ্রাসে স্বল্প সময়েই এই ঐতিহাসিক স্থানটি তার নিদর্শন হারাবে এমনটাই মনে করেন অনেকেই। কয়েকবছর আগেই এতো পরিমাণ সুড়কি খসে না পড়লেও বর্তমানে তার খসে পড়ার মাত্রা অধিক হারে হয়েছে। লবণাক্ততার প্রভাব দেয়ালের গায়ে বেশি লাগাই বাইরের অংশটি বেশি পরিমাণ খারাপ হতে দেখা যায়।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/10/IMG_2492.jpg)
শুধু এই স্থাপনাটি নয় বরং সকল স্থাপনাগুলোই লবণাক্ততার গ্রাসে অতি অল্প সময়েরর মধ্যেই মাটির সাথে মিশে যাবে। আর শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায় এগলোর নাম দেখা যাবে এমনটাই বলতে চেয়েছেন এলাকাবাসী। লবণাক্ততার প্রভাবে নিজস্ব ব্যক্তি মালিকানা বাড়িতে বর্তমান সময়ে প্রতিবছর চুনকাম করার পাশাপাশি কয়েক বছর পর পর যেখানে প্লাস্টার করতে হয় সেখানে কালের স্বাক্ষী হয়ে দীর্ঘদিন অপরিচর্যা, অবহেলা ও সংস্কার না হওয়া স্থাপনাগলো কতদিন টিকে থাকবে এমনটাই সংশয় রয়েছে এলাকাবাসীর। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আ.ন.ম আবুজর গিফারী বলেন, ‘পুরাতন স্থাপনাগুলো সংস্কার করা জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ চলছে। আশা করি আমরা ইতিহাসের স্বাক্ষী পুরাতন স্থাপনাগুলো সংস্কারের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখতে পারব।’