দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে আছি

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান

‘রাতে ঘুম হয় না। খোলপেটুয়া নদী তিন তিনবার আমার ঘর নিয়ে গেছে। এবার ভাঙলে আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না। কিন্তু দেখার কেউ নেই। ভেঙে ভেসে গেলে ওরা চিড়ে মুড়ি নিয়ে আসে, আমাদের ত্রাণ দরকার নেই, বাঁধ ঠিক করে দাও।’ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার আইলাদুর্গত দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুরের কামালকাটি গ্রামের যুবক উত্তম কুমার মন্ডল এভাবেই ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের রাতের অভিজ্ঞতার কথা বলতে যেয়ে জরাজীর্ণ খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাধের বর্ণনা দিচ্ছিলেন।

4

তিনি বলেন, ‘দিনটি ছিল শনিবার টিভি, মোবাইলে ঘুর্ণিঝড় বুলবুল সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে সংকেত দিচ্ছিল এবং সংকেত প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছিল। তখন আমরা গ্রামের সবাই খুব আতংকে ছিলাম। কারণ আমাদের গ্রামে কোন সাইক্লোন শেল্টার নাই। বুলবুল ঝড় যখন নেমে এলো আমরা ক্লাবের সবাই মাইক নিয়ে গ্রামবাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য ঘোষণা দিতে থাকলাম এবং গ্রামের যুবক ছেলেদের সবাইকে রাতে ক্লাবে আসার জন্য অনুরোধ করলাম। রাত ৮টার দিকে আমরা ২০/২৫ জন ছেলে ক্লাবে উপস্থিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম নদীতে যত ক্ষণ জোয়ার থাকবে ততোক্ষণ পর্যন্ত আমরা ক্লাবে থাকবো।’

1

গতবার ফণি ঝড়ের সময় রাতের বেলায় ভেঁড়ি বাঁধের রাস্তায় হঠাৎ ভাঙন দেখা দেয়। সেই রাতে যুবকরা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীর ভেঁড়িবাঁধের রাস্তায় কাজ করে ভাঙন রোধ করেন। ফণি ঝড়ের সময় তাঁরা যখন ভেড়িবাঁধে কাজ শুরু করেন এবং ওই রাতে কাজটি ফেসবুক লাইভে দিলে তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের টনক নড়ে। তারা পরের দিন এসে স্থানটি দেখে ও পরে কাজ শুরু করে। ওই সময় বাঁধের কাজটি না হলে বুলবুল ঝড়ের সময় বাঁধ ভেঙ্গে যেত।

জানা যায়, জোয়ারের সময় যদি পশ্চিম দিকে ঢেউ উঠে আঘাত আনে তা হলে ভেঁড়িবাঁধের রাস্তা ভেঙ্গে গিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে পারে। যতো দুর সম্ভব ভেঁড়িবাঁধের রাস্তাটা রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। তা নাহলে পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পানিতে ভেসে যাবে। মানুষ আবার নতুন আইলার মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উত্তম কুমার বলেন, আমাদের সবার মাঝে বারেবারে ভাবিয়ে তুলছিল। আর সংকেত যখন ১০ থেকে ১১ দিলো তখন আমরা ভাবলাম আর বুঝি রক্ষা নেই। কিভাবে আমাদের গ্রামের মানুষ বাঁচবে? এখানে তো আর কোন সাইক্লোন শেল্টার নেই। রাত সাড়ে ১১টা ঘূর্ণিঝড় বুলবুল তখন আরো তীব্র আকার ধারণ করলো। ঝড়ো হাওয়া তখন পূর্ব উত্তর দিকে বইছে। জোয়ারের পানি ভেঁড়ি বাঁধের রাস্তার কানায় কানায় পূর্ণ। ঢেউগুলো আছড়িয়ে পড়ছে অন্য কূলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেভাবে ঢেউ গর্জন করছিলো তা যদি আমাদের কুলে পড়তো তা হলে আমাদের বাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হয়ে যেত। মানুষের দুঃখের সীমা ছিল না। রাত ১.৩০ মিনিটের সময় জোয়ারের পানি কমে গেলে আমরা চিন্তা মুক্ত হলাম এবং সবাই ঝড়ের মধ্যে বাড়ি ফিরলাম। তারপর আবার ৩.৪৫ মিনিট থেকে বুলবুল ঝড়ের তান্ডবলীলা শুরু হলো। সময় যতো বাড়ছে ঝড়ের গতি ততো বাড়ছে। পাশের বাড়ি থেকে চিৎকার আওয়াজ ভেসে আসছিল। কিন্তু যেতে পারছিলাম না ঝড়ের কারনে। পরে শুনলাম ঘর পড়ে গেছে। যখন ঝড় ও জলোচ্ছাসের খবর শুণি তখন আমরা খুব আতংকে থাকি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘুর্ণি ঝড় আমাদের প্রতি নিয়ত সঙ্গি হয়ে দাড়িয়েছে। ভেঁড়ি বাঁধ রক্ষায় সব সময় আমাদের ঝুড়ি কোদাল নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে।’

2

উত্তম কুমার জানান, ওয়াপদা আগে ২০/২৫ হাত চওড়া ছিল। ভাঙতে ভাঙতে এখন ২/৩ হাত আছে। যেকোন সময় তাও ভেঙ্গে যেতে পারে। জোয়ারের স্রোত ও ভাটার স্রোত নদীর পূর্বকুল কামালকাটি গ্রামের ধার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে ওপদা রাস্তার নীচের থেকে মাটি সরে যাচ্ছে এবং ওপদা ভেড়িবাঁধের রাস্তা ভেঙ্গে যাচ্ছে। সরকারিভাবে ভেড়ি বাঁধ সংস্কারে বিভিন্ন সময় কাজ হয়। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। কারণ নদীর চরের মাটি কেটে বাঁধ উঁচু দেখানো হয়। তিনি জানান, তাদের অভিজ্ঞতায় প্রথমে জিআই বস্তায় বালু ভর্তি করে ব্লক ফেলে কাজটি করলে স্রোতের গতি কিছুটা কমবে ও পলি পড়বে। সরকারি লোকজন তাদের কোন কথা না শুনে তাদের মত করে ভেড়িবাঁধ সংস্কার করেন। পরিকল্পনা মত কাজটি করলে বাঁধ মজবুত হবে ও সরকারি অর্থ অপচয় হবে না।

3

তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের (কামালকাটি) ভেড়িবাঁধ যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। অতি দ্রুত ভেড়ি বাঁধ সংস্কার করা না হলে যে কোন সময় ভেঙ্গে আবারও আইলার মত অবস্থা হতে পারে। বেড়িবাঁধ ভেঙে কোথাও দুই ফুট, কোথাওবা তিন ফুট অবশিষ্ট রয়েছে। যা জোয়ারের তোড়ে যেকোন সময় ভেঙে গোটা ইউনিয়ন প্লাবিত হতে পারে। ভাঙন আতংকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে এলাকার মানুষ। বেড়িবাঁধ ভাঙলে ইউনিয়নের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ সব ভেসে যায়। নষ্ট হয়ে যায় সব অবকাঠামো। জলে চলে যায় সরকারের কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড।’

happy wheels 2

Comments