এক সময়ের ফসল গ্রাম, এখন প্রায় মরুভূমি
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপূর্ণ দেশ। বিভিন্ন কারণে দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। বিভিন্ন দুর্যোগের সাথে লড়াই করে আমাদের টিকে থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। পাহাড় পাদদেশীয় অঞ্চল ও হাওর অঞ্চলের জনমানুষের দুর্যোগজনিত সমস্যা আরো ব্যাপক। যার সমাধান করাটা খুবই দুরহ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ ভারত থেকে নেমে আসা অনেক পাহাড়ী ছড়া নদ নদী প্রতিবছর বালি পাথর দ্বারা আবৃত করছে ভাটি বাংলার অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের।
সম্প্রতি বারসিক নিউজ.কম এর কথা হয় চন্দ্রডিংগা গ্রামের বাসিন্দা সুনীল মাড়াক ও পরিমল মাড়াক এর । তাদের সাথে আলাপচারিতার প্রেক্ষিতে লেখাটি তৈরী করেছেন মো. এরশাদ আলী। লেখক এখানে তাদের মূখের ভাষাকেই লিখিত রুপ দিয়েছেন, তবে শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে নিজস্বতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন।
বালুছারা গ্রাম এখন বালিময়:
বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ভারত সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের পাদদেশের একটি ছোট গ্রাম চন্দ্রডিংগা। এটি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নে অবস্থিত। আমাদের গ্রামের পূর্বপাশে শিংকাটা, দক্ষিনে বাঘবেড় পশ্চিমে বেতগড়া ও উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিশাল পাহাড়ী অঞ্চল যেখান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিনটি ছড়া চন্দ্রডিঙ্গা, হাতিবেড় ও বেতগড়া ছড়া। এই সব ছড়ার পানির সাথে বালি, পাথর , কয়লা ও খনিজ পদার্থ মিশে এক সাথে নেমে আসে বাংলাদেশের চন্দ্রডিঙ্গার মত পাদদেশীয় অনেক অঞ্চলে।
চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামবাসীর কাছে কৃষিই হল প্রধান জীবিকায়নের উৎস অথচ যা আজ ধ্বংসের মুখে। কৃষির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হচ্ছে কৃষি জমি নষ্ট বা বালিতে ঢাকা পড়ে যাওয়া। পতিত থাকছে বালিময় কৃষিজমিগুলি। ফলে কৃষি জমির পরিমাণ কমে গেছে। কৃষি জমি কমে যাওয়াতে প্রভাব ফেলছে তাদের অর্থনীতিতে। শুকনো মৌসুমে সেচের সংকট দেখা দিচ্ছে। যেটুকু আবাদ করা হচ্ছে সেখানেও আশানুরুপ ফলন পাচ্ছেন না কৃষক। পানি বাহিত চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে সেখানকার মানুষ জন। চুলকানি ও হাতে পায়ে ঘা দেখা দিচ্ছে।
চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের নামকরণেরও একটা ইতিহাস আছে। এলাকাটি একসময় হাওর ছিল যা এর নাম দেখেই বোঝা যায়। বর্তমানে গ্রামের ভৌগলিক অবস্থার সাথে এর নামকরনের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের আর একটি নাম হল আনচেংগ্রী। আর এই আনচেংগ্রী গ্রামের নামকরণ করা এইভাবে যে ‘এলাকাটা যেহেতু হাওর ছিল সেহেতু এখানে আনচেং বা বালি মাটি থাকার কোন প্রশ্নই উঠে না বরং এলাকাটা কাদা মাটিতে ভরা ছিল। তাইতো পরবর্তীতে গ্রামটার নাম হয়েছে আনচেংগ্রী বা বালুছাড়া।
চন্দ্রডিংঙ্গা গ্রামবাসীদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ পতন ঘটতে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকে। আজ থেকে তিন বছর আগেও পাহাড়ী বালির সমস্যা ছিলনা। ছিল না প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যা যা আজ গ্রামবাসী সেইসব সমস্যার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন।
পাহাড়ি বালি আসার কারণ:
চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামে বালি আসার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ হলো ভারতের অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন যার মধ্যে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ ও বি এস এফ এর জন্য ক্যাম্প তৈরী প্রধানদায়ী বলে আমাদের মনে হয়। এছাড়া উজান এলাকায় অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক বনভূমি উজাড়, কয়লা ও পাথরের খনিসহ নানান বাণিজ্যিক অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার যাবতীয় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ভাটি বাংলার কৃষিজীবনের জনমানুষের। দিন দিন এমন উন্নয়ন প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে নানা ভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। যে সমস্যা নিরসের কোন উপায় খুজে পাচ্ছি না আমরা।
কৃষিক্ষেত্রে সমস্যা:
চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের সিংহভাগই কৃষিজীবি ও শ্রমজীবি। এই কৃষির উপর নির্ভর করেই পরিচালনা করতে হয় আমাদের প্রতিদিনকার জীবন। কিন্তু হঠাৎ করে আসা পাহাড়ী বালি আমাদের কৃষি জমি কেড়ে নিয়েছে। থমকে দিয়েছে কৃষকের পথচলা। কৃষি জমিতে যেভাবে বালি ও পাথর ছেয়ে গেছে তাতে করে সেখানে কোন কিছু উৎপাদন করার মত কোন কৌশল বা পদ্ধতি খুজে পাচ্ছি না আমরা। বাধ্য হয় কৃষিজমিগুলো পতিত রাখতে হচ্ছে।
বোরো মৌসুমে দেখা দিচ্ছে পানির স্বল্পতা। বালি আসার পূর্বে বোরো জমিতে সেচের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হতো না। ছড়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাওয়া যেত সেচের জন্য। এই বেশ কয়েক বছর বছর যাবৎ সেচের ক্ষেত্রে পানির সাময়িক স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। কৃষিতে পাহাড়ী বালির আক্রমণ দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পাহাড়ী বালিতে প্রায় ২০ একর আবাদী জমি ঢাকা পরেছে। বালির আস্তর পরেছে কোন স্থানে ৩ ফুট কোন স্থানে ৪ ফুট।
স্বাস্থ্য জনিত সমস্যা:
চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের মত অনেক সীমান্তবর্তী গ্রামেই ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, বুকের ব্যথা, রক্তচাপ, চর্মরোগ সহ নানা নিত্যনতুন অসুখ। গ্রামের মুরব্বি এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় পাহাড় থেকে আসা বিষাক্ত লোনার কারণে হাত ও পায়ে ঘা সৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড়ী লোনা আসার আগে এমন ঘা কারো হতে দেখিননি।
পুষ্টিজনিত সমস্যা:
চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসী হল গারো, হাজং। তাদের খাদ্য তালিকায় অচাষকৃত বা কুড়িয়ে পাওয়া সব্জির ব্যবহার বেশী দেখা যায়। আগে ছড়ার দুই পাশে কচু, লতা, পালইশাক, থানকুনি, তিত বেগুন, বাসক, হেলেঞ্চা, (গারো নাম) চংরু, ইত্যাদি শাক সব্জি পাওয়া যেত। এই সব সব্জির উপর নির্ভর করে এখানকার অধিবাসীরা তাদের নিত্যদিনের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতো। পাহাড়ী বালির ফলে ছড়ার দুইপাশ আজ বালিতে ঢেকে গেছে। যার ফলে ছড়ার দুই পাশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকা সব্জিগুলো বালির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে দেখা দিচ্ছে অচাষকৃত সব্জির সাময়িক সংকট। সেই সাথে দেখা দিচ্ছে পুষ্টির স্বল্পতা।
গ্রামটির ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়াটি বিভিন্ন অঞ্চলের ভিতর দিয়ে বয়ে গিয়ে হাওরে পতিত হয়েছে যার ফলে হাওর থেকে অনেক এই ছড়া দিয়ে আসতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, শামুক, কাকড়া। যা আমিষের একটা বড় অংশ পূরণে সহয়তা করতো। সীমান্তবর্তী আদিবাসীদের কাকড়া ও শামুক অন্যতম একটি প্রিয় খাবার। এগুলি এই ছড়াতেই পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বালি দিয়ে ছড়া ভরাট হয়ে যাওয়াতে কাকড়ার গর্তও ভরাট হয়ে গেছে যার জন্য এখন এই ছড়াতে কাকড়া পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা মিলছেনা শামুকের। ছড়া ভরাট হওয়ার ফলে ছড়ার গতিধারার পরিবর্তন হচ্ছে। ছড়াটি আর আগের মত প্রকৃতির নিয়ম মেনে উজানের মায়া ছেড়ে ভাটিতে অর্থাৎ হাওরে পতিত হতে পারছে না। যার ফলে হাওরের মাছ থেকে আমরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি।
বালি থেকে জমি রক্ষার কোন পথ খুজে না পেয়ে তাই আমরা বাধ্য হচ্ছি জমি পতিত রাখতে। কিন্তু আবাদী জমির মায়াজাল ছিন্ন করতে না পেরে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বালির মধ্যে কিছু একটা করার। আমরা দেখতে চাই আবারোও সেই জমিতে সোলানী ফসল। গ্রামের মানুষজনের ব্যাক্তিগত এবং সংগঠিতভাবে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করছে প্রতিনিয়ত। এমন দুইটি উদ্যোগ হলো- সুকুমার হাজং(৪৫) এর পরীক্ষামূলকভাবে কালাই চাষ করার সিদ্ধান্ত , যুব সমাজের উদ্যোগে অস্তিত্ব রক্ষায় ছড়ার পাশে সাময়িক বাধ তৈরী।