গ্রামের অসহায়দের পাশে দাঁড়ালেন কৃষাণী হোসনা আক্তার
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
কৃষির সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। মানব সমাজের ইতিহাস এগিয়েছে কৃষিকাজ শুরু করার মাধ্যমে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যই কৃষিকে বাংলাদেশের প্রধান উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। জীবনকে নিরাপদ ও গতিশীল করার জন্যই মানুষ হাজার বছর ধরে ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন কর্মকা-কে ঘিরেই গড়ে উঠেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র।
আমাদের গ্রামীণ সমাজ এই ঐতিহ্যকেই ধারণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। সেখানে কৃষি কাজের পাশাপাশি আছে অন্যের প্রতি মমত্ববোধ, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা। আমাদের সকলেরই জানা আছে কৃষি কাজের সূচনা হয়েছিল নারীর হাত ধরেই। সেই থেকে অদ্যাবধি নারী তাঁর স্বভাবজাত আচরণের মধ্য দিয়ে সেই ধারাকে অব্যহত রেখেছেন। বর্তমান সময়ের এই কঠিন পরিস্থিতির মাঝে থেকেও প্রতিজন নারী নিজের একাগ্রতা আর নিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষি কাজ করে চলেছেন।
লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের একটি ছোট গ্রাম দরুন হাসামপুর। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতো এখানেও মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। এবং অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ে করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে থেমে আছে সমস্ত কর্মকা- সেখানে বসে নেই আমাদের কৃষাণীরা। তাঁরা নিজেদের সাধ্যমতো আঙিনায় সব্জী রোপন করে, পরিচর্যা করে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
দেশের সমস্ত কার্যক্রমে লকডাউন মেনে নিতে পারলেও খাবারের বেলায় তা চলবেনা। আমাদের সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতে হলে খাবার খেতেই হবে। আর সেই খাবারের উপাদান যদি হয় ঘরের আঙিনায় তবে সেটি বেশি নিরাপদ।
দরুন হাসামপুর গ্রামের কৃষাণী হোসনা আক্তার অনেক বছর যাবৎ কৃষির সাথে জড়িত। নিজের বাড়ির আঙিনার অল্প জায়গায় তিনি সারা বছর বিভিন্ন ধরণের সব্জী চাষ করে থাকেন। এর পাশাপাশি তিনি হাঁস, মুরগী ও ছাগল পালন করেন। ধান চাষ করার মতো জমি নেই তাঁর। সব্জী বিক্রি করে যা রোজগার করেন তা দিয়ে ৫ জনের সংসার চলে।
প্রতি বছরের মতো এবারও তিনি আঙিনায় মিষ্টিকুমড়া, শিম, ডাটা, দেশি লাউ, শশা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, করলা ইত্যাদি রোপন করেছেন। এছাড়া তার বাড়িতে ৪ধরণের লেবু, ২ধরণের বারোমাসী বেগুন, মরিচ, মিষ্টি আলু ইত্যাদিও রয়েছে। এ সকল সব্জী তিনি নিজে খান আবার মাঝে মাঝে প্রতিবেশিদের মাঝেও বিতরণ করেন। তবে বিক্রি করেন বেশি।
এবারও কিছু সব্জী বিক্রি করেছিলেন। পরে যখন দেখলেন সারা দেশের সব কিছু বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, বাজার বসছেনা, কেউ কাজে যেতে পারছেনা তখন থেকে তিনি আর সব্জী বিক্রি করছেননা। বর্তমান সময়ে অনেকেই খাদ্য সংকটে ভুগছেন। এই গ্রামে অনেক দরিদ্র মানুষ আছে। যাদের শুধু বসত ভিটাটুকু আছে। তারা কেউ রিক্শা বা অটো চালায় কেউ কৃষি শ্রমিক বা রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় আবার এইসময়ে বেকার অবস্থায় আছেন। ভাত খেতে পারলেও সব্জীর চাহিদা পূরণ করতে পারছেনা। এই অবস্থায় তিনি এগিয়ে এসেছেন। তিনি তার সংগঠনের (মিলে মিশে কাজ করি কৃষাণী সংগঠন) সদস্য ও প্রতিবেশিদের মাঝে বিভিন্ন সব্জী বিতরণ করা শুরু করেছেন। সংগঠনের ১৪জন সদস্য ছাড়াও এ পর্যন্ত প্রায় আরো ২০জনকে বিভিন্ন সব্জী তিনি বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন।
তিনি সবাইকে বলে রেখেছেন যার যখন সব্জী দরকার হবে তখন যেনো তার কাছ থেকে নিয়ে যায়, কেউ যেনো খাওয়ায় কষ্ট না করে। এছাড়া সবাইকে নিজের গাছের লেবু বিতরণ করে গরম পানি দিয়ে খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। যাতে করোনা প্রতিরোধ করা যায়। প্রায় প্রতিদিন ২/৩জন তার বাড়ি থেকে সব্জী, লেবু ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি প্রতিবেশিদের পাশাপাশি ভিন্ন গ্রামের কৃষাণীদের মাঝেও সব্জী বীজ বিতরণ করেছেন।
এই গ্রামের বেশ কিছু মানুষ দিন আনে দিন খায়। বাজারে সব্জীর দাম কম থাকলেও শ্রমজীবি মানুষদের বর্তমানে কোনো উপার্জন নেই। তাই তারা সব্জী কিনে খেতে পারছেনা। দেশে লকডাউন শুরু হওয়ার পর অনেকেই কষ্ট করে জমানো টাকায় চাল, ডাল কিনে রেখেছিলেন। কিন্তু সব্জী কিনে বেশি দিন রাখা যায়না, নষ্ট হয়ে যায়। দরিদ্র মানুষদের এই অসহায় পরিস্থিতিতে নিজের মতো করে সহযোগিতা করছেন হোসনা আক্তার।
তিনি বলেন,“আমার একটু জায়গা আছে দেইখ্যা আমি চাষ কইরা খাইতাছি, বেঁচতাছি। অনেকের বাড়িতে জায়গা কম। তারা চাষ করতে পারেনা। আবার যারা কামলা (শ্রমিক) দিয়া খায় তারার অহন রোজগার বন্ধ। পয়সা নাই, কিনতেও পারেনা। আমার যা আছে আমি যদি খাইতে পারি অন্যেরাও খাইবো। বাজারে নিয়া বেঁচলে দাম কম পাওয়া যায়। তার চাইতে মাইনষে খায়া বাঁচুক। কেউ খাইলে আমার কম পড়তো না। আমরা সবাই সব সময় এক সাথে থাহি। কত সুখ দু:খের আলাপ করি। এর মধ্যে কেউ না খায়া থাকলে আমার খারাপ লাগবো। সময়তো আর এই রহম থাকতোনা। একদিন সব ঠিক অইবো। তহন আবার সব্জী বেঁচবাম।”
হোসনা আক্তারও একজন দরিদ্র নারী। অনেকের মতো অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা তার নেই। উৎপাদিত সব্জী বিক্রি করলে এই সময়ে হয়তো তাঁর নিজের পরিবারের উপকারে আসতো। কিন্তু তিনি তা না করে এগিয়ে এসেছেন অন্যের প্রয়োজনে। তার মতো এমন অসংখ্য গ্রামীণ নারী আছেন যারা কোনো না কোনো উপায়ে অন্যদের সহযোগিতা করছেন। ব্যাগ ভর্তি চাল, ডাল দিয়ে সহযোগিতা করলে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় স্থান পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামের নীরবে, নিভৃতে অসহায়দের সহযোগিতাকারী নারীরা স্থান পায় আমাদের হৃদয়ে।