মানিকগঞ্জের লোক ঐতিহ্য: কুটির বাঁশ বেত শিল্প
মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম
‘বাড়ির চারপাশ, বাঁশ-বেতে ছড়িয়ে যাক, আসুন প্রাকৃতিক উৎস সুরক্ষা করি, কৃত্রিমতা বর্জন করি’। দেশের অন্যতম মধ্যসমতল ভূমি আমাদের মানিকগঞ্জের বিভিন্ন জনপদে বাঁশ ও বেতজাত সামগ্রী আজও আমাদের চোখে পড়ে। সনাতন ধর্মালম্ভীদের মধ্যে মুনীঋষি সম্প্রদায় এই পেশাকে এখনো ধরে রেখেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কারিগর সম্প্রদায় তাঁত শিল্পের সাথে অনেকেই বাঁশ বেতের কাজ করত, বর্তমানে সেই দৃশ্য চোখেই পড়ে না। কৃষিভিত্তিক প্রতিটি পরিবারেই বাঁশ বেতের ব্যবহার থাকলেও আজ প্লাস্টিক শিল্প ও কৃত্রিমতায় তারাও বৈশ্বিক পুঁজিবাদের কাছে পরাজিত হয়েছে।
আমাদের গ্রামীণ লোকায়ত সমাজে গৃহ নির্মাণ কাজে চাটাই, ঝুড়ি/সাঝি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও দৈনন্দিন গৃহস্থালী কাজে চালুনি, খালই, হাতপাখা, কুলা, মোড়া, মাছ ধরার বাহারি রঙের বিভিন্ন ফাঁদ, ছড়ি, লাঠি ইত্যাদির ব্যবহার রয়েছে। বেত সামগ্রীর মধ্যে এক সময় ধামা, কাঠা, সের, ছিলো গৃহিনীদের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপকরণ। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার সরুপাই গ্রামের লক্ষী মণি দাস, নিপেন মণি দাস, পশ্চিম হাট বড়িয়ালের খগেন মুনি দাস, বিমলা ও জবা মনি দাস, অষ্টদোনার অঞ্জলী মনি দাস, মিতরা নারায়ন মনি দাস, পালড়ায় ফেলানি মনি দাস, গাংডুবিতে শীতল পাটনিসহ বেশ কিছু পরিবারের মধ্যে এই চর্চা এখনো অব্যাহত আছে। এছাড়াও সিংগাইর অঞ্চলের ঘোনাপাড়া, বকচর, বাইমাইল, স্বরুপপুর গ্রামের কেবলমাত্র সনাতনধর্মালম্বী মনিঋষি সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো স্বল্পপরিসরে এই শিল্প টিকে আছে। এক সময় এই শিল্পীরা পাড়া মহল্লায় ঘুরে ঘুরে বেত সামগ্রী নির্মাণ ও মেরামত করে দিতেন।
আবার বেত শিল্পের অস্তিত্ব চোখে পড়ে কেবলমাত্র হরিরামপুর উপজেলাধীন কালুই শিকদার বাড়ী, ঘিওর এর নারচী ও ঠাকুরকান্দি গ্রামের কয়েকটি পরিবার। এখানে বেতের তৈরী ধামা, কাঠা, সের ইত্যদি মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবারহ করা হয়। বিভিন্ন মেলাগুলোতে তাদের তৈরী সামগ্রীগুলো দেখা যায়।
উন্নয়নকর্মী গাজী শাহাদত হোসেন বাদল বলেন, “প্রাকৃতিক উৎস হ্রাস পাওয়াতে বাঁশ-বেতের উৎপাদন ও সরবারহ একেবারেই কমে যাওয়ার ফলে এই সব বাঁশ বেত শিল্পীরা পেশা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।” উন্নয়নকর্মী সুবির সরকার বলেন, “একদিকে যেমন প্রাকৃতিক উৎসের কমতি রয়েছে অন্যদিকে বাজার দখলের প্রতিযোগীতায় প্লাস্টিকশিল্প এগিয়ে আছে। বিধায় প্লাস্টিক শিল্পের কাছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই শিল্প পরাজিত হইতে বাধ্য।” পশ্চিম হাট বড়িয়ালের মহেন্দ্র মনি দাস বলেন, “এক সময় কৃষি ও গৃহ কাজে বাঁশের ও বেতের ব্যাপক ব্যবহার ছিলো। এছাড়াও নদী, নালা, খাল-বিল সচল ছিলো বিধায় অনায়াসে নৌপথে এগুলো নিয়ে হাটবাজারে আসা যাইত এবং গ্রাম্য প্রতিটি হাট-বাজারে বাঁশ-বেত কেনাবেচা হইতো। বর্তমানে অধিকাংশ হাট বাজারেই এগুলো বিক্রির দৃশ্য চোখে পড়ে না।”
সিংগাইর উপজেলার বায়রা অঞ্চলে এখনো বেশ বাঁশের আবাদ লক্ষ করা যায়। নদীপথ না থাকার কারণে বেপারীরা গ্রাম থেকেই বাঁশ ক্রয় করে রাস্তায় রাখে এবং ট্রাকে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যায়। এছারাও ঘিওর উপজেলার তরা, জাবরা, পেঁচারকান্দা, ডাউটিয়া, ঝিটকাসহ গুটি কতেক বাঁশের হাট লক্ষ করা গেলেও বেতের হাট একেবারেই চোখে পড়ে না। ঘিওর সদরে ধাইরা পাড়া বাঁশ শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানে চাটাই, ধারা, বেড়া ইত্যাদি তৈরীর জন্য অনেক পেশাজীবি রয়েছেন। মানিকগঞ্জ শহরের টিএন্ডটি অফিসের পূর্ব পাশে রাস্তার পারে বেশ কিছু বাঁশজাত সামগ্রী তৈরীর কারখানা লক্ষ করা যায় এবং তাদের তৈরী ধারা, বেড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে সরবারহ করা হয়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে বাঁশ-বেতের শিল্প আমাদের হাজার বছরের গ্রামীণ লোকায়ত সংস্কৃতির এক বিশাল ধারা। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার দাপটে প্লাস্টিক শিল্পের ব্যপক প্রচার ও প্রসার ঘটলেও বর্তমান স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞানীরা প্লাস্টিক বর্জন করার জন্য বিশ্ববাসীকে অনুরোধ করছে। প্লাস্টিক ব্যাবহারে মানুষের বিভিন্ন ধরনের মারাত্বক রোগ ব্যাধি দেখা দেয়ার ফলে সচেতন মহল এখন আবার নতুন করে বাঁশ-বেতের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। ফলে বাঁশ-বেতের চাহিদা আগের চেয়ে বৃদ্বি পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে প্লাস্টিকের চেয়ে এর দাম একটু বেশী হলেও এটি অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। আমরা মনে করি কেবল সচেতনতার মাধ্যমেই এই শিল্পের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এটিকে সমাজে স্থায়ী রুপ দিতে হলে অবশ্যই সামাজিক ন্যায্যতার সমাজ গড়তে হবে। তাই আসুন বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে আমরা প্লাস্টিক শিল্প বর্জন করি, বাঁশ-বেতসহ হাতের তৈরী তৈজসপত্র অধিক ব্যাবহার করি। এই শিল্পের কারিগরদেরকে সংগঠিত করে শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তুলি। সামাজিক ন্যায্যতার সমাজের পথে অগ্রসর হই।