সাম্প্রতিক পোস্ট

সকলে মিলে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার মন্ডুমালা এলাকায় ৪৭টি মাহালী পরিবারের বসবাস। দূর্জধন মাহালী আজ থেকে ৯৫ বছর আগে এখানে বসতি গড়েন। এখন তিনি গত হলেও এখানে ৪৭টি পরিবারে ৩৪৫ জন বসবাস করছেন। বাঁশ ও বেতের কাজ ছাড়াও বর্তমানে নারী-পুরুষ কৃষিতে শ্রম বিক্রয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সহজ ভাষায় অনেকটা সাদামাটাভাবেই কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন।


যাপিতজীবনে অনেক সমস্যা থাকলেও তাঁরা সব সময় হাসি খুশি থাকতেই পছন্দ করেন। তাঁদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিজেদের গ্রামে বিভিন্ন সমস্যা আছে। সমস্যাগুলোর অন্যতম হচ্ছে সুপেয় পানির এবং দিন যত যাচ্ছে তাঁদের এ সমস্যাও জটিল হচ্ছে বলে মনে করছেন গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি রাফায়েল মূর্মু (৬৫)। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের একটি পরিবারেও খাওয়ার পানির কোন উৎস নেই। আমরা পাশের প্রেটোল পাম্পের সাবমারসিবল পাম্প থেকে মাসে ১২০ টাকার বিনিময়ে দিনে ২ বার ৩ কলস করে খাওয়ার পানি নিয়ে আসি। গোসলের ব্যবস্থা গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটি বাণিজ্যিক পুকুরে হয়। গোসলের পুকুর দূরে বলে নিরাপত্তার খাতিরে দলে দলে ভাগ হয়ে গোসল করতে যাওয়া হয়। এভাবে চলতে চলতে আজ অনেকেই চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর আগে গ্রামের একজন তিনমাসের গর্ভবতী নারী পানি নিয়ে আসতে গিয়ে গর্ভপাতের শিকার হয়। ঘটনাটি সবার মনকে নাড়া দিয়েছে।’


এখন আশার কথা হচ্ছে গ্রামের প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সবাই মিলে একত্রিত হয়েছেন। নিজেরা একটি সংগঠন তৈরি করেছেন যার নাম দিয়েছেন ‘মাহালীপাড়া বাঁশ বেত উন্নয়ন সংগঠন’। এ সংগঠনটির সভাপতি চিচিলিয়া হে¤্রম (৪৮)। সংগঠন এবং গ্রামের সকল কাজে সহযোগিতা করেন বারসিক’র রিনা টুডু। তিনি বলেন, ‘বারসিক’র মাধ্যমে আমি আমার নিজ গ্রামের উন্নয়নে সহযোগিতার সুযোগ পেয়েছি। এটা আমার কাছে বড় পাওয়া।’


সংগঠন থেকে গ্রামের সব পরিবারকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এরপর নিয়মিত সংগঠনের সভায় গ্রামের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়। পানির সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে সংগঠন থেকে একত্রে মন্ডুমালা পৌরসভায় গিয়ে সমস্যার কথা বলা হয়। সেখান থেকে উপজেলা পর্যায়ে যোগাযোগের কথা বলা হলে সমস্যাটি সমাধানের জন্য উপজেলা থেকে একটি সাবমারসেবল মটর দেওয়া হয়। কিন্তু মটরটি বসানোর খরচ গ্রামকে বহন করতে হবে। দরিদ্র বলে মটর বসানোর খরচ তাঁদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই তারা মটর বসানোর কাজ যে কয়জন শ্রমিক আসবে তাঁদের তিন দিনের খাবার খরচ বহন করার সিদ্ধান্ত নেন।


এভাবে ওই শ্রমিকদের খাবার খরচ বহন করার জন্য গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে এক কেজি করে চাল ও ১১০ টাকা করে চাঁদা ধরা হয়। এ কাজটি সমন্বয় করছে গ্রামের সংগঠনের সদস্যরা। এ বিষয়ে সংগঠনের সভাপতী চিচিলিয়া হে¤্রম বলেন, ‘আমরা ছোট বেলায় পড়েছি একের লাঠি দশের বোঝা, সেখান থেকেই শিক্ষা নিয়ে আমরা সবাই মিলে এক সাথে হয়ে গ্রামের ছোট-বড় সমস্যাগুলো সমাধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের গ্রামের কবরস্থান ঘেরা দেওয়ার কাজও ঠিক এভাবেই করেছি।’
এখানে উল্লেখ যে, মাহালী সম্প্রদায়ের ২৫ শতাংশ জমির একটি কবরস্থান আছে। কিন্তু পাশের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলের কারণে আজ সেই জমি মাত্র ১৮ শতাংশে এসে ঠেকেছে। সমস্যাটি সমাধানের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করা হলেও কোন সমাধান আসেনি। এরপর সংগঠন থেকে নিজেরা আলোচনা করে পরিবার প্রতি ১৫০ টাকা করে চাঁদা ধার্য করা হয়। পাশাপাশি মন্ডুমালা পৌরসভা,উপজেলা প্রসাশনে যোগাযোগের মাধ্যমে কাজটি সমাধান করেছেন। যেখানে সর্বমোট খরচ হয় ৩১ হাজার ৫শ’ ৭০ টাকা। এই কাজটিও সমন্বয় করেন সংগঠনের সদস্যরা।


সকলে মিলে যদি কোন সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে তা খুব সহজে সমাধান হয়ে যায়। মাহালী সম্প্রদায়ের কাজগুলো সেই প্রমাণই দিয়েছে।

happy wheels 2

Comments