হারিয়ে যেতে বসেছে ধান কাটার জনপ্রিয় ‘ব্যাগার’ পদ্ধতি
রাজশাহীর তানোর থেকে অমৃত সরকার
আর অল্প কিছুদিনের মধ্য বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই শুরু হবে ধান কাটার মহোৎসব। কিছু কিছুু এলাকায় এরই মধ্যই শুরু হয়ে গেছে ধানকাটা ও নেওয়ার কাজ। বলছি আমন মৌসুমের ধানের কথা। বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহীর প্রধান প্রধান ফসলগুলোর মধ্য আমন ধান অন্যতম। বরেন্দ্র এলাকার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওঁগা জেলায় এই মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে ধান চাষ হয়ে থাকে। বর্তমানে এই এলাকাই প্রায় একই ধরনের ধান জাতের চাষ হওয়ার কারণে তা কাটার উপযোগীও হয় একসাথে। ফলে দেখা দেয় শ্রমিকসংকট। তবে এই এলাকায় আমনের তুলনায় বোরো মৌসুমের ধান চাষে শ্রমিক সংকট দেখা দেয় অনেক বেশি।
ব্যাগার পদ্ধতি
প্রচলিত ‘ব্যাগার’ শব্দ হলেও এর মানে কৃষকদের কাছে ছিল আলাদা। এই ব্যাগারে কাজের অংশই ছিল বেশি। একটি গ্রামের কিছু মানুষ ১০-১৫ জন মিলে একটি দল তৈরি করত এবং ধান কাটার মৌসুমে সবাই মিলে একে অপরের জমিতে ধান কেটে মাড়াই করে দিত এবং সারাদিন তার বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করতো। এটাকেই ব্যাগার বলা হতো। এভাবেই সবার জমিরই ধান পর্যায়ক্রমে কেটে মাড়াই করে দেওয়া হত। এই ব্যাগার পদ্ধতির কারণে কৃষক সমাজে সম্প্রীতি বিরাজ করতো। ফলশ্রুতিতে দলের একজনের জমি বেশি থাকলেও কোন সমস্যা মনে হয়নি দলের অন্য সদস্যদের কাছে, যা বর্তমান সময়ে খুব একটা দেখা যায় না।
এ বিষয়ে বেলপুকুর গ্রামের কৃষক মোঃ আব্দুল রহমান(৬৫) বলেন, “আগে আমাদের এলাকার সব গ্রামেই এ পদ্ধতির প্রচলন ছিল। তবে এখন আর দেখা যায় না। আমিও ব্যাগার পদ্ধতিতে অনেক ধান কেটে দিয়েছি।” তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, “ কাজের দিনে দলের পুরুষ সদস্যরা জমিতে কাজ করতাম তখন পরিবারের নারী সদস্যরা একত্রিত হয়ে রান্না-বান্নার কাজ করতেন এবং দিন শেষে সবাই একসাথে রাতের খাবার শেষ করতাম। খাবারের সময়ই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো পরের দিন কার জমিতে ধান কাটা হবে। এভাবে দেখা যেতো, যার জমিতে বেশি জরুরি তার জমিতেই পরের দিনে ধান কাটা হতো।” তিনি আরও বলেন, “এক গ্রামে ৪-৫টি এমন দল গঠন হত যারা সারা গ্রামের ধান কেটে দিত।” এই প্রসঙ্গে নারায়ণপুর গ্রামের অপর এক কৃষক শ্রী আশুতষ বর্মণ (৫৮) বলেন, “তখনকার দিনে সবাই আমরা এক ধানের চাষ করতাম না। একেকজন একেক জাতের ধান চাষ করতাম। পাশাপাশি আমাদের মাঠেও বিভিন্ন জাতের ধান চাষ হত। ফলে তা পরিপক্কও হত আগে ও পরে। যার কারণেই আমাদের অনেক সুবিধা হত ব্যাগার পদ্ধতিতে ধান কাটতে।” তিনি বলেন, “তবে বর্তমানে সারা মাঠেই প্রায় একই জাতের ধানচাষ হয়। পরিপক্কও হয় একই সময়ে। এই কারণেই এখন বোরো মৌসুমে বেশি শ্রমিক সংকট দেখা দেয়।” গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘ব্যাগার’ পদ্ধতির হারিয়ে যাওয়া বিষয়ে গোকুল-মোথুরা গ্রামের বয়ষ্ক কৃষক শ্রী রমেন্দ্রনাথ সূত্রধর (৮৬) বলেন, “এখনকার মানুষের মধ্য সম্পৃতি অনেক কমে গেছে। তারা এখন সবসময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কোন কিছুই ত্যাগ করতে চায় না।” মানুষের ভেতরে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির বন্ধন কমে যাওয়ার কারণে ‘ব্যাগার’ পদ্ধতিটি হারিয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন।
অতীতে কৃষকরা নিজেদের সমস্যা সমাধানে নিজেরা সবসময় সচেষ্ট থেকেছেন। তাঁরা সবসময় চিন্তা করেছেন কৃষিকে কিভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ জন্য নিজেরা নিজেদের প্রচেষ্টায় আবিষ্কার করেছেন অনেক পদ্ধতির। ‘ব্যাগার’ তেমনই একটি কার্যকর পদ্ধতি। এই পদ্ধতির কারণে অতীতে কৃষকরা কোনসময়ে শ্রমিক সঙ্কটে পড়তেন না, যা বর্তমানের কৃষকরা ওই সঙ্কটে পড়েন। ‘ব্যাগার’ পদ্ধতির কারণেই কৃষকদের মধ্যে একটি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বন্ধন ছিলো। তবে আজকের আধুনিক কৃষিতে এই বন্ধন খুব একটা দেখা যায় না।