স্বপ্নের কারিগড় একজন মিন্টু স্যার: দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ঠিকানা “শিক্ষার আলো” পাঠশালা
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক
কিছু কিছু অতি সাধারণ মানুষের ঘরেই জন্ম হয় অসাধারণ কিছু মানুষের। যাদের কর্ম পরিধির আলোকবর্তিকার রশ্মি ছড়িয়ে যায় বহু মানুষের স্বপ্নের কাছে। যে কাজে হাসি ফোটে সমাজের অবহেলিত আর দরিদ্রদের মুখে। আর সেই কর্ম মূল্যায়নের স্বীকৃতির স্থান থাকে মানব হৃদয়ের বেশ ওপরে।
তেমনি শিক্ষা বিস্তারের এক আলোকময় কারিগড় সানি রহমান মিন্টু। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গিলন্ড গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা মোতালেব হোসেন ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসার চালান। এলাকার হত দরিদ্র কোমলমতি কোন ছেলেমেয়েরা যাতে শিক্ষার আলো থেকে ঝরে পড়ে না যায়, সেজন্যই নিজ উদ্যোগেগিলন্ড গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন “শিক্ষার আলো” নামের একটি পাঠশালা। ব্যতিক্রমী “শিক্ষার আলো পাঠশালা”ই হচ্ছে এলাকার দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের শিক্ষালয়। যেখানে গিলন্ড, জয়নগর ও শৈলকুড়া গ্রামের অস্বচ্ছল কৃষক, দিন মজুর, রিকশা চালকের সন্তানদের বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়ানো হয়। তার কাজই তাকে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষ থেকে করেছে আলাদা। অনন্য সাধারণ হয়ে উঠেছেন তিনি।
লেখাপড়া করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই জীবন-সংগ্রামের সঙ্গে যুদ্ধ করে মিন্টু নিজেকে তৈরি করেছেন একজন আদর্শবান মানুষ হিসাবে। অর্থের অভাবে নিজে ভালো কোন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে না পারলেও তিনি কখনোই মনোবল হারাননি। তাই তো এলাকার হত দরিদ্র কোমলমতি কোন ছেলে-মেয়েরা যাতে শিক্ষার আলো থেকে ঝরে পড়ে না যায় সেজন্যই নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন “শিক্ষার আলো” নামের পাঠশালাটি। ব্যতিক্রমী এই পাঠশালা গ্রামের হতদরিদ্র শিশুদের বিনামূল্যে পাঠদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মানিকগঞ্জ সরকারী দেবেন্দ্র কলেজের মাষ্টার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র এই মিন্টু।
শিক্ষার আলো পাঠশালার তত্ববাধয়ক সানি রহমান মিন্টু জানালেন, ২০১১ সালে তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে গ্রামের দরিদ্র শিশুদের জন্য বিনামূল্যে একটি পাঠশালা খুলেছিলেন। একসময় বন্ধুরা সবাই সেই পাঠশালার হাল ছেড়ে দিলে কিছুদিন পাঠশালাটি বন্ধ থাকে। কিন্ত হাল ছাড়েননি মিন্টু। ২০১৪ সালে নিজে একাই সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে শিক্ষার আলো নামের পাঠশালাটির কার্যক্রম নতুন করে শুরু করেন।
মিন্টু বলেন, “আমি খুবই হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা ঝালমুড়ি বিক্রি করে অতি কষ্টে আমাদের সংসার চালায়। অর্থের অভাবে নিজে কখনো প্রাইভেট পড়তে পারিনি। সেই উপলব্ধি থেকে আমি শিক্ষার আলো পাঠশালাটি প্রতিষ্ঠা করেছি। যাতে এলাকার দরিদ্র ঘরের ছেলে মেয়েরা আমার পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে ভালোভাবে লেখা পড়া করতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “অর্থের অভাবে যাতে কারো লেখা পড়া বন্ধ হয়ে না যায় তাই আমি নিজে প্রাইভেট পড়িয়ে যা রোজগার করছি তার প্রায় সবটুকুই এই পাঠশালার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের লেখা পড়ায় ব্যয় করছি। আমার কাছে শিক্ষা নিতে কোন ছাত্র-ছাত্রীকে একটি পয়সাও দিতে হয় না। বরং খাতা ও কলমসহ যার যা প্রয়োজন তার সবটুকুই আমি বহন করে আসছি আমার সাধ্য মতো। শিক্ষাদানের পাশাপাশি আমি সামাজিকভাবে মাদক বিরোধী আলোচনা এবং বাল্য বিয়ে বোধে কাজ করে যাচ্ছি।”
ভোরের সূর্য উঠার পর পরই মিন্টুর পাঠশালায় চলে শিক্ষা কার্যক্রম। বর্তমানে সেখানে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে পড়–য়া ৬৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ভোর পৌনে ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত ৫ম শ্রেণী, ৭টা থেকে সোয়া ৮টা পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণী ও চতুর্থ শ্রেণীর ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দান করা হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষাকার্যক্রমে অংশ নেয়। মিন্টুর পাঠশালায় বিনামূল্যে শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে ওই শিক্ষার্থীদের বাইরে কোন ধরনের প্রাইভেট পড়তে হয় না। মিন্টুর এই পাঠশালায় যে সকল ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা বেশির ভাগই হতদরিদ্র পরিবারের। যারা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষক রেখে প্রাইভেট পড়াতে পারেন না তারাই এই পাঠশালার সদস্য।
মিন্টুর পাঠশালায় পড়তে আসা চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী আরিফা আক্তার জানালেন, “বাবা টেম্পো চালায়। তাই লেখাপড়ার জন্য বাইরে কোন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারি না। সেজন্য মিন্টু সারের পাঠশালায় পড়ে প্রতিদিন স্কুলে যাই। মিন্টু স্যার সবসময় যতœসহকারে আমাদের পড়ান।” ৫ম শ্রেণীর ছাত্র রাজিব জানালেন, “মিন্টু স্যার আমাগো খুব ভালোভাবে পড়ালেখা বুঝিয়ে দেন। এখান থেকে পড়া শিখে স্কুলের পড়া দিতে সহজ হয়।” তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র রাজিব বলে, “আমরা গরিব মানুষ। টাকার দিয়ে কোথায় প্রাইভেট পড়তে পারি না। তাই মিন্টু স্যারের কাছে টাকা ছাড়া পড়তে পারছি। শুধু তাই নয় মিন্টু স্যার আমাগো প্রতিমাসে খাতা ও কলম কিনে দেন।”
পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া প্রতিবন্ধী শিক্ষাথী সুমন মিয়ার পিতা পান্নু মিয়া বলেন, “মিন্টু নিজেও গরিব ঘরের সন্তান। তাই গরিরের দুঃখ তিনি বুঝেন। এলাকায় আমাদের মতো গরিব মানুষের ছেলে মেয়েকে মিন্টু খুবই যতœসহকারে শিক্ষাদান করায় আমরা উপকৃত হচ্ছি।” তার কাছে লেখাপড়া করার কারণে আমাদের ছেলে মেয়েকে প্রাইভেট পড়তে হয় না।” স্বামী পরিত্যক্ত রশি বেগম জানান, তার মেয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। অর্থাভাবে মেয়েকে তিনি প্রাইভেট পড়াতে পারেন না। তাই সে বিনামূল্যে মিন্টুর কাছে মেয়েকে পড়তে পাঠান।
অদম্য মেধাবী সানি রহমান মিন্টু বলেন, “একটি এনজিওর দোচালা ঘরের ভেতর বর্তমানে ৬৩ জন ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষা দিতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। আমার কোন চাওয়া নেই শুধু সরকারের কাছে একটাই আহবান পাঠশালাটি টিকিয়ে রাখতে একটু জায়গা আর একটা ঘরের প্রয়োজন।”
এলাকার সমাজসেবক উজ্জল খান বলেন, “মিন্টুর এই উদ্যোগকে আমি স্যালুট জানাই। এলাকার অনেক গরিব ছেলে মেয়ে টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়তে পারে না। তাদের জন্য মিন্টুর শিক্ষার আলো পাঠশালাটি অনেক উপকারে আসছে।” স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রাকিব হোসেন ফরহাদ বলেন, “মিন্টু এলাকার গরিব ছেলে মেয়েদের যেভাবে বিনামূলে শিক্ষাদান করে আসছে এটা প্রশংসনীয়। শুধু চেয়ারম্যান হিসাবেই নয় একজন সচেতন মানুষ হিসেবে মিন্টুর পাঠশালা চালাতে যদি কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হয় সেটা আমি করবো।”