একজন কবিরাজ ইছাহাক বাঙালির ভেষজ ঔষুধ
পাভেল পার্থ
‘আগের দিনে এতো গরম ছিল না।
দিনে দিনে গরম বাড়তাছে।
আগে আষাঢ়ে ঝুম বৃষ্টি হইতো। এখন বৃষ্টি অনিয়মিত হয়।
আগে পৌষ-মাঘেই শতি বেশী আছিল। কিন্তু এখন মাঘেই যা কিছু শীত পড়ে।
আবহাওয়া বদলাইয়া গেছে। এতে বনের খুব ক্ষতি হইতাছে।
ঝর্ণা শুকাইয়া গেছে। বিদেশী গাছ লাগাইয়া সর্বনাশ হইছে বনের।
এখন আর পাহাড় বন থেইক্যা আগের কাজের গাছ-পান কিচ্ছু খুইজ্যা পাওয়া যায় না’।
কথাগুলো আক্ষেপ নিয়ে বললেন, কবিরাজ ইছাহাক বাঙালি (৬০)। ইছাহাক বাঙালিরা মিলে তৈরি করেছেন এক নতুন সংগঠন। যেখানে সংগঠনের সকলেই হিন্দু, মুসলিম, খ্রীস্টান ধর্মের পরিচয়ের বাইরে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন ‘বাঙালি’। সংগঠনের সদস্যরা নিজেরা মিলে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ভাষা দিবসসমূহ পালন করেন। বাংলা ভাষা চর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য তারা পালন করেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান। সাজ বেগম ও আবদুল হকের ছেলে জীবিকার প্রয়োজনে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংসা ইউনিয়নের টিলা এলাকা নকশি গ্রামে আশ্রয় নেন। ৬ কাঠার বসত বাড়ির প্রায় ৩ শতাংশ জমিতে এখন কেবল ঘৃতকাঞ্চন চাষ করছেন। কালমেঘ, উলটকম্বল, বাসক, শতমূলী বিক্রি করেন। প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় ঝিনাইগাতী ও ধানশাইল হাটে ভেষজ সামগ্রী ও ঔষধি গাছের চারা বিক্রি করে তার আয় হয় ৪০০-৫০০ টাকা। প্রতি মাসে কেবল এই ভেষজ বিক্রি করেই তার আয় প্রায় ৫০০০ টাকা। এটি দিয়েই চলছে তার সাত সদস্যের সংসার। তার স্ত্রী শেফালী বেগম সব কাজে সহায়তা করেন, নার্সারির রক্ষণাবেক্ষণসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঔষধ বানানো।
ইছাহাক বাঙালি যখন নকশি গ্রামে আসেন তখনই তার পরিচয় হয় এলাকার বিখ্যাত মান্দি কবিরাজ রামসিং রাংসার (৮০) সাথে। রামসিং রাংসার সাথে পাহাড় জংগলে ঘুরে ঘুরে তিনি শালবন এলাকার ঔষধি গাছ চিনেছেন। জেনেছেন এসবের আদিবাসী ব্যবহার। পরবর্তীতে দুজনে মিলে পাহাড় জংগল খুঁজে দু®প্রাপ্্য ঔষধি গাছগাছড়া সংগ্রহ করে এনে বিক্রি করেছেন কবিরাজদের কাছে। ঝিনাইগাতীর নজমুল কবিরাজ তাদের উল্লেখযোগ্য ক্রেতা। ঝিনাইগাতী, শেরপুর, নন্নী, ধানশাইল, নালিতাবাড়ি থেকে কবিরাজরা এসে তাদের কাছ থেকে ঔষধি গাছগাছড়া নিয়ে যায়। ইছাহাক বাঙালি মূলতঃ ঋতু পরিবর্তনের ফলে সংগঠিত মৌসুমী জ্বর-ঠান্ডা-সর্দি-কাশির ভেষজ ঔষধ বানিয়ে বিক্রি করতেন। প্রাথমিকভাবে তিনি কালমেঘ, বাসক, যষ্টিমধু, গুলঞ্চ ব্যবহার করে ঔষধ তৈরি করতেন। ২০০০ সাল থেকেই তিনি সর্দি-কাশির ভেষজ সিরাপ রামসিং রাংসার সাথে স্থানীয় হাট বাজারে বিক্রি করতেন।
ইছাহাক বাঙালি টের পান স্থানীয় এলাকায় গত পনের-বিশ বছরে আবহাওয়াগত একটা পরিবর্তন ঘটে চলেছে। তীব্র গরম, তীব্র শীত ও ঘোর বর্ষায় দেখা যায় সর্দি-জ্বর-কাশি-কফ বেশি বেশি করে হচ্ছে। এসব সর্দি-কাশি সচরাচর আগের নিয়মে হচ্ছে না এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে নতুন উপসর্গ। উছাহাক বাঙালি দেখতে পান আবহাওয়াগত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সর্দি-জ্বরের ক্ষেত্রে তার পূর্বতন ভেষজ সিরাপ খুব একটা কাজে দিচ্ছে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত তিনি চেষ্টা করতে থাকেন আবহাওয়াগত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সর্দি-কাশি সারানোর ক্ষেত্রে কার্যকরি ঔষধ আবিষ্কারের। ২০০১ সালের দিকে তিনি একাজে সফল হন। দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে কালমেঘ, যষ্টিমধু, আদা, গুলঞ্চ, তুলসী, তেজপাতা ও বাসক থেকে তিনি তৈরি করেন তার নতুন ভেষজ সিরাপ। প্রাথমিকভাবে তিনি ও তার পরিবার এটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে আশেপাশের আত্মীয় পরিজন ও প্রতিবেশীরা এটি ব্যবহার করে উপকার পান। বর্তমানে এটি স্থানীয় এলাকায় সর্দি-কাশি সারানোর জন্য বেশ জনপ্রিয় ও কার্যকর সিরাপ। মূলতঃ কম আয়ের দরিদ্র বাঙালি ও আদিবাসীরাই তার এই সিরাপের প্রধান ক্রেতা ও ব্যবহারকারী। সাম্প্রতিক আবহাওয়াগত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নতুন উপসর্গ নিয়ে হাজির সর্দি-কাশির ক্ষেত্রে এই ভেষজ সিরাপ বেশ কাজে লাগছে। বিশেষতঃ তীব্র গরমের ফলে সৃষ্ট সর্দি-কাশির ক্ষেত্রে ইছাহাক বাঙালির এই ভেষজ সিরাপ খুব সস্তা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন, সুলভ ও কমমূল্যের নিরাময়ী হিসেবে কদর পাচ্ছে। বর্তমানে ১০০ মি.লি এক বোতল ভেষজ সিরাপের মূল্য ৩০ টাকা।
সিরাপে ব্যবহৃত গাছগাছড়া পূর্বে পাহাড় জংগল থেকে সংগ্রহ করলেও এখন ইছাহাক বাঙালি নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন এসবের এক বিশাল বাগান। তার বাড়িতে শংখমূল, বিন্দুমূল, একপুরুষ, শতমূলীর মতো দু®প্রাপ্য উদ্ভিদসহ প্রায় ১০০ প্রজাতির বেশি ঔষধি উদ্ভিদ রয়েছে। ইছাহাক বাঙালি যেমন আদিবাসী মান্দিদের ঔষধি জ্ঞান ব্যবহার করেছেন ঠিক সেরকমই আদিবাসীদের প্রতি রয়েছে তার অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তার আবি®কৃত ভেষজ সিরাপ একইসাথে আদিবাসী-বাঙালি ঐক্যকেও সমুন্নত রেখেছে।