বরেন্দ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। বরেন্দ্র অঞ্চল বাংলাদেশ তথা বঙ্গের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল। এই অঞ্চলকে আদিভ‚মিও বলা হয়ে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোকে নিয়ে বরেন্দ্র বরেন্দ্র অঞ্চল গঠিত। লাল রঙের মাটির প্রকৃতি ও তার বিশেষ সংস্কৃতির জন্যে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। অনেকে খিয়াড় অঞ্চল হিসেবেও বরেন্দ্র অঞ্চলকে চিনেন। অতীতে বরেন্দ্র অঞ্চলের রুপ বৈচিত্র্য ও মানুষের জীবন প্রবাহের সাথে বর্তমান বরেন্দ্র অঞ্চলের মিল খুঁজে পাওয়া অনেকটা দুষ্কর হয়ে উঠে। উঁচু নীচু টিলা আর ঠাঁঠাঁ ও লু-হাওয়া বয়ে যাওয়া বরেন্দ্রর রুপ বৈচিত্র্য এখন চোখে পড়ে কম। বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশগত পরিস্থিতির নানা রূপ ও বৈচিত্র্যও পরিবর্তনশীলতার লক্ষ্য করা যায়। বহুবিধ উন্নয়নকে কেন্দ্র করে কোনটি ডেকে এনেছে এই এলাকার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় আবার কিছু উন্নয়নের কারণে এই অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে জীবনপ্রবাহ।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃতি সন্তান, নদী ও পরিবেশ গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন- একসময় বৃটিশরা এই অঞ্চলের সমৃদ্ধময়তা ও বৈশিষ্ট্যের কারনে বঙ্গ অঞ্চলের মধ্যে প্রথমত টার্গেট করে বরেন্দ্র অঞ্চলকে। কারন এখানকার মাটি আবহাওয়া ছিলো অত্যন্ত সহনীয় ও সুন্দর। তারা সে সময় এই অঞ্চলের বন জঙ্গল কেটে সেসব মাটিতে চিকন ধানের চাষ করতো বাণিজ্যিকভাবে। সেসব চাল তারা রপ্তানি করতো সেই সময়ে পশ্চিামা দেশে। বৃটিশদের সেই সময় থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চল তাঁর আপন মহিমা ও সৌন্দর্য হারাতে থাকে। যুগে যুগে বরেন্দ্র অঞ্চলের সম্পদ এবং মহিমাই শুধু ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু বরেন্দ্র অঞ্চলকে তাঁর নিজের মতো করে টিকে থাকতে সহায়তা বা সেরকম উন্নয়ন কার্যক্রম কমেই লক্ষ্য করা গেছে।
সম্প্রতি বারসিক ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজ(বিয়াস) এর আয়োজনে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলসম্পদ ও ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তরের ক্রম অবনমন বিষয়ক নবীন ও প্রবীন আলোচনায় অংশগ্রহণকারীগণ বরেন্দ্র অঞ্চলের নানামূখী পরিবর্তনশীলতার দিকগুলো তুলে ধরেন। উক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবর্তনশীলতার সেকাল এবং একাল নিয়ে কথা বলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলসম্পদ ও পরিবেশ গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। এই আলোচনা অনুষ্ঠানে বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন তরুণ সংগঠনের তরুণগণ অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনায় উঠে আসে বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবর্তনশীলতার দিকগুলো। বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় প্রচুর পরিমাণে খাল-খাড়ি তথা প্রাকৃতিক জলাভূমি ও ও নদ নদী ছিলো। নানা কারণেই সেগুলো এখন আর আগের মতো প্রাকৃতিক অবস্থায় নেই। প্রাকৃতিক বিলগুলো দখল হয়ে সেখানে এখন কৃত্রিম পুকুড় খনন এবং হাইব্রিড জাতের মাছের চাষ হচ্ছে। যার ফলে দেশীয় মাছের সংখ্যা কমে গেছে। বিল ও প্রাকৃতিক জলাভ‚মি কেন্দ্রিক জলজ উদ্ভিদবৈচিত্র্য বিলীন হয়েছে। একে কেন্দ্র করে নানা প্রাণবৈচিত্র্যও হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে শস্য ফসলের জমি কেটে কৃত্রিম পুকুর খনন করে তাতে পাতালের পানি ব্যবহার করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। রবিশস্য ফসলের জন্য বিখ্যাত বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি নির্ভর ধানের চাষ করার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে নেমে গেছে। যার ফলে কোন কোন অঞ্চলে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। একমূখী শস্য ফসলের চাষাবাদের কারনে বৈচিত্র্যময় শস্যফসলের জাতগুলো বিলুপ্ত হয়েছে।
ভৌগোলিক কারণে মানুষের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো সেই আদি সংস্কৃতিও অনেকটা বিলুপ্ত হয়েছে। মানুষের মধ্যে মানুষের যে সহসম্পর্ক, মানুষের সাথে প্রকৃতির যে সহসম্পর্ক তা কমে গেছে। যার ফলে প্রকৃতি নির্ভর জীবীকার মানুষগুলো দিনে দিনে আরো প্রান্তিক অবস্থায় চলে এসেছে।
এর মধ্যে দিয়েও কিছু উন্নয়ন এই এলাকার মানুষের বৈচিত্র্য সুরক্ষাসহ স্থানীয় পরিবেশ প্রতিবেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীগণ বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়নে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ দেন। যাতে এই অঞ্চলের একটি দীর্ঘ মেয়াদী ইতিবাচক উন্নয়ন সাধিত হয়।
উক্ত নবীণ প্রবীন আলেচানায় বরেন্দ্র অঞ্চলের ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলেন- বারসিক এর পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ^াস। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চলের সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম।