প্রকৃতিকে নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন
বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছে। বদলে ফেলেছে হাজার হাজার বছরের কৃষি, খাদ্য ও জীবনযাপনের সংস্কৃতি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে গ্রহণ করেছে আধুনিকতাকে। তবে বহু কিছুরই পরিবর্তন এবং আধুনিকায়ন হলেই যে সার্বিক মুক্তি মিলবে সেই ভুল ধারণা মানুষ বুঝতে পারছে। কারণ প্রকৃতিতে টিকে থাকা প্রাণীগুলোর মধ্যে মানুষ অনন্য প্রাণী হলেও বৈশ্বিক রাজনীতি এবং পুঁজির আগ্রাসনে কবলে কেবল লাখ লাখ প্রাণ এবং অনুপ্রাণ নয়, মানবজাতিই আজ বড় বিপদ আর বিপর্যয়ের সম্মুখিন। কিছু মানুষের অতি লোভ আর পুঁজির আগ্রাসন আর ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড নিজেকে না জড়িয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে। সর্ব প্রাণের বেঁচে থাকা এবং মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা ভেবে পরিবেশ প্রকৃতি প্রাণ-বৈচিত্র্যনির্ভর জীবনযাপন এখনো ধরে রেখেছেন এমন মানুষ এখনো আমাদের সমাজে দেখা যায়।
তাদের মধ্যে এমন একজন মানুষ হলেন মোচর মিয়া। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চল লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে পাটগ্রামচরে বাড়ি মোচন মিয়া পেশা একজন কৃষক। কৃষি কাজ যেন তাঁর জীবনের সঙ্গী হিসেবে গেঁথে আছে। সারাদিন মাঠে ঘাটে চক পাথরে কাজ করেন। মাঠ ঘাট যেন তাঁর জীবনের সঙ্গী। সকালে বাড়ি থেকে বের হয় সারদিন কেটে যায় কাজের মাধ্যমে। কৃষি কাজ গরু ছাগল ও হাঁস, মুরগি পালন করে তাঁর পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয়। চরের গাছ পালা, মাটি, আলো বাতাস, বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রাণীই তাকে সহায়তা করে। মোচন মিয়া বলেন, ‘প্রকৃতি নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে, প্রকৃতির সকল উপাদান যেন বেঁচে থাকার সুখের স্বপ্ন।’
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলা বন্যা কবলিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। প্রতিবছর বন্যা ও নদী ভাঙনের ফলে এই এলাকার প্রাণ-প্রকৃতিকে আঘাত করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আবাদী ফসল, নষ্ট হয় গাছ পালা, রাস্তা ঘাট, স্কুল কলেজসহ প্রকৃতির বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ লতা পাতা। দিন দিন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্যা অচাষকৃত উদ্ভিদ, ঔষুধি গাছ, চরের হোগলা, ক্যাইশা, নলখাগড়া সহ নানান ধরনের উদ্ভিদ। ফলে মানুষসহ বিভিন্ন প্রজাতি টিকে থাকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে এলাকার মানুষের স্থানীয় চর্চা, অভিজ্ঞতা ও তাদের চিরাচরিত জ্ঞান ভান্ডার। পশু পাখি প্রাণী সম্পদসহ কৃত্রিম খাবার, কৃত্রিম প্রজনন ও বাসস্থান অনুপযোগি হয়ে পড়ছে। বিকল্প কিছু আসলে আমাদের স্থায়ী সমাধান না। প্রকৃতির সকল উদ্ভিদ, প্রাণ, জীব ও অণুজীব রক্ষা করার আমাদের সবার দায়িত্ব। তা না হলে এ ধরা অবাসযোগ্য পৃথিবীতে পরিণত হবে।
কিন্তু প্রকৃতির অফুরন্ত দান ভান্ডার যাতে হারিয়ে না যায়, তার নিরন্তর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন মোচর মিয়ার মত প্রান্তিক কৃষকরা। দেশি জাত বৈচিত্র্য, বীজ সংরক্ষণ, কৃষকের সাথে উপকরণ তথ্য বিনিময়, লোকায়েত র্চ্চাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। মোচন মিয়া আরো বলেন, ‘বারসিক সংস্থার কর্মকর্তারা চরে আসে কৃষকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, সংগঠন তৈরি, দেশি জাতের ফসল চাষে উদ্বুদ্ধকরণে সহায়তা করে থাকে।’
চলতি মৌসুমে তিনি স্থানীয় জাতের কালোজিরা, মেতি, তিসি, সজ, রাধুনি, মিষ্টি সজ, ফিরিঙ্গি ৬ জাতের মসলা নিয়ে চাষ করেছেন। তাছাড়া তাঁর বসতবাড়িতে মরিচ, বেগুন, ডাটা, পুইশাক, পেয়াজ, রসুন, লাউ, মিষ্টি লাউ, ফুলকপি, বাধা কপি. টমোটো, বরবটি, শিমসহ নানা ধরনের সবজি রয়েছে। এই প্রসঙ্গে পাটগ্রামচরে বাড়ি কৃষক রফিজা বেগম বলেন, ‘চক পাথার ও মাটঘাট থ্যাহা ঘাস গরু ছাগলের আহার কইমা যেতেছে। মানষেরা এহন ঘাস মারা বিষ দেয়, সার দেয় চক থ্যাহা গরু ছাগলের পশুপাহির খাওন কইমা যাইতেছে। আগে চকে কত ঘাস থাকত হামা, গইচা, বাদাল, দুর্বা, হেনসি, কলমি, গোল হেনসি, নলখাগড়া, জলদুর্বা এহন কমে যাইতেছে।’
হরিরামপুর উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার আব্দুস ছালাম বলেন, ‘প্রাণ-প্রকৃতি মানুষকে খাদ্য, চিকিৎসাসহ নানান উপাদান প্রদান করে। মোট কথা মানুষের বেঁচে থাকতে নানানভাবে এই প্রকৃতি সহায়তা করে থাকে। আমরা জেনে বুঝে অনেকে তাদের আঘাত করি। ফলে আমরা পদে পদে বিপদের সম্মুখিন হই, যা মোকাবেলা করার সক্ষমতা আমাদের অনেক সময় থাকে না। প্রাণ প্রকৃতির সহ-অবস্থানকে আমরা আঘাত করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃতির রোদ বৃষ্টি, আলো বাতাস, নদীনালা, খাল বিল, মাইটাল, ডোবা, নদীর কোল, প্রাকৃতিক জলাশয়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। সেই প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য যদি আমরা এগিয়ে না আসি তাহলে আমাদের বেঁচে থাকাটা দুির্বসহ হয়ে পড়বে।’