বিএমডিএর পানিব্যবস্থাপনা কৃষকবান্ধব হওয়া উচিত
রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিপ্রতিবেশ এবং সাংস্কৃতি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিামাঞ্চলে অবস্থিত বরেন্দ্র অঞ্চল নামে এই অঞ্চলটি খরাপ্রবণ। এখানকার আবহাওয়া এবং মাটির বৈশিষ্ট্য আলাদা। এই অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। সার্বিকভাবে এই অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের একটি রেজুলেশনের মাধ্যমে ১৯৯২ সালে তৎকালিন রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মূলতঃ কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এর সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮ (২০১৮ সালের ৩৬ নং আইন) প্রণীত হয়। এতে বলা হয়, ‘বরেন্দ্র এলাকার সার্বিক উন্নয়ন এবং তদসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য কার্য সম্পন্ন করিবার লক্ষ্যে আইনটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে’। আইনটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সম্পূর্ণ আইনজুড়ে শুধু এক শ্রেণীর মানুষের সংশ্লিষ্টতা। এখানে যাদের জন্য উন্নয়ন, উন্নয়নে যাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সেই মানুষগুলোর অংশগ্রহণ এবং মতামত দেবার আইনি কোন স্থানই দেয়া হয়নি। কৃষক, আদিবাসী প্রতিনিধিসহ নেই কোন জনগোষ্ঠীর কার্যকর অংশগ্রহণ। আইনটির সেকশন ৮ (১) এর ধারায় একটি উপদেষ্টো পরিষদের কথা বলা হয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদে কোন কৃষক এবং আদিবাসী প্রতিনিধি নেই।
বিএমডিএর শুরু থকেই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপশি সব থেকে বেশি যে কাজটি তারা করে থাকে, তা হলো পানি কেন্দ্রিক সমস্যা সমাধান। শুরু থেকেই বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানটি ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রতি জোর দেবার কারণে বর্তমান এমন সংকট তৈরি হয়েছে যে দিনে দিনে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ভয়ংকরভাবে নেমে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে একমূখী অধিক পানি নির্ভর শস্য ফসলের চাষাবাদ বেশি হয়েছে। একসময়ে এসে কৃষক ধান চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। অথচ এই অঞ্চলটি বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ হতো একসময়। কম পানি নির্ভর রবি শস্যের চাষ বেশি হতো। বিএমডিএ এর কাজের ধারাবাহিকতায় একসময় প্রতিষ্ঠানটি
তার আওতাধীন এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার পূর্বক সেচ কার্যক্রমের লক্ষ্যে নতুন গভীর নলকূপ/শক্তি চালিত পাম্প স্থাপন, পরিচালনা, সেচনালা নির্মাণ, বিদ্যুতায়ন, গভীর নলকুপ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষন, খাল/পুকুর পুনঃখনন পূর্বক ব্যবহার, সেচের গভীর নলকূপ থেকে খাবার পানি সরবরাহ ইত্যাদি কার্যক্রম নিয়ে বিএমডিএ সেচ নীতিমালা-২০০৮ প্রণয়ণ করে।
নীতিমালাটিতে ভালো কিছু কৃষকবান্ধব অনুচ্ছেদ থাকলেও তা বাস্তবায়ন না করে বিএমডিএর পক্ষে এবং প্রবাবশালীদের পক্ষে যায় সেকল অনুচ্ছেদ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ডিপ দখল এবং ডিপকে কেন্দ্র করে ডিপের আওতাভুক্ত এলাকার কৃষি জমিতে পানি বৈষম্য চরম আকার ধারণ করছে। পানিকে কেন্দ্র করেই বরেন্দ্র অঞ্চলে সামাজিক সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বলা যায়, পানি নিপীড়নের নয়া কৌশল ও অস্ত্র হলো এখন বরেন্দ্র ডিপগুলো। ডিপগুলোকে কেন্দ্র করেই এখানে পানি রাজনীতির এক নয়া আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। ‘জোর যার মল্লুক তার’ বিষয়টি এমন হয়েছে। এই ডিপকে কেন্দ্র করেই বরেন্দ্র জনপদে সামাজিক সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবেশ নষ্ট হচ্ছে। হত্যা, মারামারি, ডিপ দখল, পানির অন্যায্যতা, পানি হীনতা এবং প্রান্তিক কৃষকের পানির অধিকার বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এখানেও নীতির নামে আইনের নামে এক শুভংকরের ফাঁকি এবং প্রভাবশালীদের এক নতুন সুযোগ করে দিয়েছে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। নীতিমালার কারণে কৃষক এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের ন্যায্যতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
নীতিমালার মধ্যে অনুচ্ছেদ ১.২ স্কীম প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুপারিশের শুধু বিএমডিএর একজন কর্মকর্তার কথা বলা হয়েছে, এখানে কৃষক এবং কৃষক সমিতির মতামতগুলো গুরুত্ব দেয়া দরকার। তেমনি আরো কিছু অনুচ্ছেদ যেমন -১.৩ এ উপজেলা সমন্বয় কমিটির কথা বলা হয়েছে, সেখানে আদিবাসী এবং কৃষকদের অংশগ্রহণ নেই। অনুচ্ছেদ ১.৭ এ কমিশনের কথা বলা থাকলেও তা স্পষ্ট নয়। একই সাথে নীতিমালাটিতে বিভিন্ন অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটি গভীর নলকুপ নষ্ট হলে তা কৃষকদের কাছ থেকেই নানাভাবে পার্টিসিপেশন ফি এর মাধ্যমে নেয়া হয়। আবার এই পার্টিসিপেশন ফি কৃষকদের নির্ধারণ করার কোন ক্ষমতা নেই, নির্ধারণ করেন একজন বিএমডি কর্মকর্তা (অনুচ্ছেদ ১.৬, ১.১৯)। অনুচ্ছেদ ১.১২ তে বলা হয়েছে, কমপানি লাগে এমন ফসলের চাষ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ডিপ অপারেটরদের সহযোগিতার অভাবে তা সম্ভব হয়না। ডিপ অপারেটর নির্বাচনে রয়েছে প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাবানদের আধিপত্য। ২.১ অনুচ্ছেদের জুলাই-ডিসেম্বর এই নিয়মে খন্ডকালিন অপারেটর মনোনয়ন এবং নবায়ন এর কথা থকলেও একটি ডিপ অপারেটর নিয়োগ যাকে করা হয়, সেই একই ব্যক্তি বছরের পর বছর চালায়, সুবিধা নেয়। আর এই অপারেটর নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালীরা। বিএমডিএ অফিস থেকে এই অপারেটর নিয়োগ করা হয়ে থাকে। ২.৪ অনুচ্ছেদের ভোটের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগের কথা থাকলেও তা বাস্তবে দেখা যায়না। ডিপভিত্তিক প্রতিটি এলাকায় একটি করে কৃষক সমিতি থাকবে, তারাই ভোটের ম্যাধমে বা লটারি করে ডিপ অপারেটর নির্বাচন করবেন। সেটা হলে দ্বন্দ্ব এবং সংকট কেটে উঠার সম্ভবানা আছে। বরেন্দ্র কৃষক মনে করেন- ডিপের ব্যবস্থাপনা এবং ডিপ পরিচালনা প্রতি মৌসুম ভিত্তিক প্রকৃত কৃষককেই দিতে হবে। এটি প্রতি মৌসুমেই পরিবর্তন হবে। যাতে আগ্রহী সকল কৃষক এই পরিচালনার দায়িত্ব পান। এককভাবে একজনকে বছরের পর বছর ডিপ অপারেটর নিয়োগ করলে তার মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসে। নীতিমালাটিতে অপারেটর হিসেবে নারীর কথা বলা থাকলেও তা বাস্তবে চোখে পড়ার মতো নয়। নীতিমালা বা আইনের বেড়াজালে প্রতিবছর বিএমডিএ সেচের যে ভাড়া নির্ধারণ করে সেটি কৃষক সমিতির মধ্যে থেকে হতে হবে। কৃষকরা মনে করেন, প্রতিবছর সেচের যে ভাড়া নির্ধারণ করে সেটি কৃষক সমিতি করবেন। এই ক্ষমতাও কৃষকদের মধ্যে থাকা উচিত। সকল আয় ব্যয়ের হিসেব ডিপভিত্তিক কৃষক সমিতি করবেন। পানি নিপীড়নের শিকার কৃষকরা মনে করেন ডিপভিত্তিক কৃষক সমিতি ডিপ ব্যবস্থাপনার সকল দায়িত্ব পালন করবেন।
কিন্তু বিএমডিএ এর নীতিমালা এবং আইনের বেড়াজালে এই সুযোগ কৃষকরা পায়না। নামামাত্র কৃষক সমিতি থাকলেও তাদের তেমন কোন ক্ষমতা থাকেনা। কৃষকরা সুযোগ পেলে তারা নিজেদের মতো ফসল ফলাতে পারবে। বিএমডিএ সেচ নীতিমালা ২০০৮ তাই পরিবর্তন করে এটি কৃষকবান্ধব করা অতিব জরুরি হয়েছে। গোটা নীতিমালাতে বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য প্রাণ প্রকৃতি সুরক্ষার দিকগুলো কোনভাবেই উল্লেখ করা হয়নি। তাই এই নীতিমালাটি সংশোধন করে কৃষকবান্ধব এবং নীতিমালার ভালো দিকগুলো বাস্তবায়নের দাবি জানান বরেন্দ্র জনপদের কৃষক। অন্যদিকে সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর কারনে বরেন্দ্র অঞ্চলে গ্রামের কৃষক, আদিবাসী, প্রান্তিক এবং দরিদ্র জনগোষ্টী তাদের জলাধার পুকুর-দিঘিগুলোতে প্রবেশাধিকা হারিয়েছে। গ্রামের ভিতরে এবং বিলের পুকুর-দিঘিগুলো লিজ দেবার কারণে সেগুলো থেকে তারা পানি ব্যবহার করতে পারেনা। একইসাথে মৎস্য আহরণের অধিকার থেকেও বঞ্চিত। বিভিন্ন সময়ে লিজ প্রথার কারণে গ্রামের পুকুরগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ী বেশি টাকার বিনিময়ে লিজ নিয়ে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে মৎস্য চাষ করার ফলে পানি ব্যবহার করা যায় না। আবার লীজ নেয়া পুকুরগুলো ব্যবহার করতে দেয়া হয়না গ্রামবাসীকে। কৃষককদের দাবি গ্রামের ভিতরের পুকুর দিঘিগুলো গ্রামের মানুষকে ব্যবহার করতে দেয়া হোক এবং সেগুলো লিজ দেয়া বন্ধ করা হোক। কৃষকরা মনে করেন, বিল বা জলাভূমিগুলো লিজ দেবার ফলে তারা ভূ-উপরোস্থ পানি ব্যবহার করতে পারেনা।
বিএমডিএ সেচ নীতিমালা ২০০৮ এবং পানি নিয়ে যেসকল বৈষম্যমূলক আইন নীতিমালা আছে সেগুলোর পরিবর্তন চায় বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক, নাগরিক সমাজ মিলে এর দাবিতে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন এবং কৃষকবন্ধন করছে। এরই ধারাবহিকতায় বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা আজ ৫ দফা দাবি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে। একইসাথে তারা বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. মো: আসাদুজ্জামানের সাথে দেখা করেন তাদের দাবি এবং স্মারকলিপি তুলে ধরেন। তাদের পাঁচ দফা দাবিগুলোর মধ্যে আছে-০১. বৈষিম্যমূলক ‘বিএমডিএ সেচ নীতিমালা-২০০৮’ পরিবর্তন করে কৃষকবান্ধব করতে হবে। ০২। ডিপ পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ ক্ষমতা কৃষক সমিতি/কৃষক সংগঠনকে দিতে হবে। সমিতির মাধ্যমেই ডিপ অপারেটর ঠিক করবেন। ০৩। সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ পরিবর্তন করে কৃষক ও জনবান্ধব করতে হবে। ০৪। খাস পুকুর দিঘি, জলাধার জলমহালগুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে, লীজ দেয়া যাবেনা। ০৫। বরেন্দ্র অঞ্চলের সকল প্রাকৃতিক জলাধারগুলো সংস্কার করতে হবে। দখলমুক্ত করে সেগুলো কৃষকদের সেচের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের শস্য ফসলের চাষাবাদের সাথে এই বরেন্দ্র ডিপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এই ডিপগুলো ব্যবস্থাপনা কৃষকবান্ধব না হলে দিনে দিনে বরেন্দ্র অঞ্চলে আরো সামাজিক সহিংসতা বাড়বে। একই সাথে আদিবাসী, প্রান্তিক কৃষক পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে।