হারিয়ে যাচ্ছে এ প্রজন্মের শৈশব ও কৈশর
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
গ্রাম আর শহর সর্বোত্র আজ কঠিন বাস্তব জীবন। এ জীবনের ব্যস্ততায় হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। ছোট্টবেলায় আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন, মামা-মামী, চাচা-চাচী, ফুপা-ফুপি, খালা-খালু, নানা-নানী, দাদা-দাদী, আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশির কত শত মানুষের স্বান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছি। আমাদের ছিল গল্প, ছড়া, কবিতা, ছন্দ, রঙ আর বর্ণের মেলা। সকালে মামা বাড়ি তো বিকালে খালার বাড়ি, সন্ধ্যায় ফুপুর বাড়ি আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। গোল্লাছুট, বউচি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ইচিং বিচিং, পাশা খেলা কত শত খেলা আর মজা তার কোন শেষ নেই আমাদের শৈশব। নানার কোলে বসে রাজ-রাণী আর রাজকন্যার গল্প, ঠাকুরমার ঝুঁলি কি যে মজার সেই দিনগুলো!
শীত আসে গ্রাম বাংলায় এক দারুণ আবহ নিয়ে। শীতের কুয়াশার চাদর, পিঠা, পায়েশ, আগুণ পোহানো আর গল্প আমাদের নিয়ে যায় দূর অতীতে। শীত মানেই গ্রামে গ্রামে আয়োজন, শীত মানেই নাইওর আসা যাওয়া। আহা কি আনন্দময়তা! বর্ষায় টইটুম্বুর হয়ে যেতো গ্রামের চারিধার। নৌকা, ভেলা আর ডিঙ্গাই ছিল আমাদের চলার সঙ্গী। গ্রামের মানুষের অনেক কষ্ট যন্ত্রণা হলেও পুরো বর্ষাটাই শিশু কিশোরদের জন্য আনন্দের। সারাদিন ডুব সাতার আর হই হুল্লোর করেই কাটতো দিন। বর্ষায় বিলে ডুব সাতার আর শাপলা, পদ্ম নিয়ে স্বপ্নিল মুহূর্ত। এভাবে হেমন্ত আর বসন্ততেও প্রকৃতি আর গ্রাম সেজে উঠে নতুন রূপে আর বর্ণে। এই নান্দনিকতায় আমাদের সবকিছুই রঙিন হয়ে উঠে। চারিদিকে কেবল আনন্দ আর উৎসব চলতে থাকে এ সময়কালে।
এই বর্ণনা আর স্মৃতিচারণ এখন সোনালি অতীত। বাংলাদেশের খুব কম গ্রাম আর শহরে এখন এমন রঙ, রূপ আর আনন্দ, উৎসব দেখা যায়। আদর, গল্প, যতœ, ভালোবাসায় জায়গায় শিশু ও কিশোরদের মনে জায়গা দখল করে নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর গেমসসহ নানান ধরণের যান্ত্রিক বিনোদন ব্যবস্থা। গ্রামের সেই একান্নবর্তী পরিবারও নেই; নেই সেই একসাথে বেড়ে উঠার শিক্ষা ও সংস্কৃতি। তাই একসাথে চলা আর ভাগ করে খাওয়ার চর্চা ও চিন্তাও হারিয়ে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের কাছ থেকে।
ঢাকার একটি পরিবারের সন্তান গাঙ্গুত্রী (১০) জিজ্ঞেস করলাম সে বিল দেখেছে কিনা। তার সোজা উত্তর: ‘না’। সে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের সবাইকে চিনে কিনা। যেমন: মামা, খালু, চাচী ইত্যাদি। সে বললো: ‘খালুকে চিনি, তবে সবাইকে চিনিনা।’
হিমেল (৯) ঢাকার অভিজাত পরিবারের সন্তান যে কখনো বিল দেখেনি। দোয়েল পাখিকে টাকার উপর দেখলেও বাস্তবে সে কখনো দোয়েল পাখি বা দাঁড়িয়াবান্ধা, বউচি খেলা খেলেনি। দাদা গ্রামে থাকে তাই তাদের সান্নিধ্যে থাকা হয় না খুব একটা, হয়তো বছরে একবার বা দু’বার দেখা হয়। একই চিত্র দেখি বন্যার (১২) ক্ষেত্রেও। সে বন্ধুদের সাথে একসাথে হাসতে খেলতে বা ঘুরতে যেতে পারে না। তার গল্প আর আনন্দের সঙ্গী হলো মোবাইলে গেমস খেলা আর টিভি দেখা। বিকাল বেলায় তার খুব ঘুরতে ইচ্ছা করে কিন্তু সে কারও সাথে ঘুরতে যেতে পারে না। শহরের ছেলে মেয়েদের বিকাল বেলার খেলা মানে গলির মধ্যে ইট দিয়ে স্ট্যাম্প বা গোল পোস্ট বানিয়ে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা। এটি আবার অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায় কোন বাড়ির কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হলে। আবার কখনও পড়ার চাপ বেড়ে গেলে তাদের খেলায় ছেদ পড়ে। পারিবারিক সময় বলতে তারা যতটুকু সময় বাসায় থাকেন প্রায় পুরো সময়ই বই বা এসাইনমেন্ট নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। যে অবসর তাদের জন্য বা তাদের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সেই অবসর তাদের মেলে না। তাই তাদের শৈশব আর কৌশর কেটে যাচ্ছে বর্ণ-গন্ধহীন ভাবেই।
গ্রামের চিত্র এর থেকে আলাদা নয়। গ্রামে এখন আর সেই আগের খেলা বা আনন্দ, ঘুরে বেড়ানোর কৈশর আর শৈশব নেই। অধিকাংশ গ্রাম পর্যায়ে পৌছে গেছে আধুনিক প্রযুক্তির সকল সুযোগ সুবিধাগুলো। মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট ইত্যাদি। এখন আর গ্রামের মাঠে বিকাল বেলায় এতো শিশু আর কিশোরদের দেখা যায় না। তারা হয় মোটরসাইকেল নিয়ে অথবা মোবাইল নিয়ে বন্ধুদের নিয়ে বসে ফেসবুকে চ্যাট করতে ব্যস্ত। নানান ধরণের মোবাইল এ্যাপস্ আর ডিভাইস নিয়েই তাদের নিত্যদিনের গবেষণা। নানা-নানী বা বয়স্কদের মুখে আমরা কতোনা গল্প শুনে বড় হয়েছি-যার কারণে আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নানান সুকুমার বৃত্তি কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সেই ‘ঠাকুর মার ঝুঁলির’ প্রতি কোন আগ্রহ বোধ করে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একজন শিশু কিশোর সংগঠক ও বিশিষ্ট চিকিৎসক ও গবেষক ড. এম এ সাঈদ বলেন, “আমাদের নতুন প্রজন্ম একটি অস্থির সময়ের মধ্যে বসবাস করছে। যে পরিবেশে সে না পাচ্ছে সুস্থ পরিবেশ, নির্মল বায়ু এমনকি বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ আত্মীয় পরিজনের ভালোবাসা। এর ফলে তার মধ্যে তৈরি হচ্ছে একাকীত্ব আর আত্মকেন্দ্রিকতা। যার ফলে তার বিকাশের পথ হয়ে যাচ্ছে সংকীর্ণ।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের নতুন প্রজন্মকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে হলে তাদের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; আরও নিশ্চিত করতে হবে তার শৈশব ও কৈশরকে।”
হারিয়ে যাচ্ছে শিশু ও কিশোরদের শৈশব আর কৈশর। আমরা চাই এই শৈশব আর কৈশরকে আমরা ফিরিয়ে আনবো। বৈচিত্র্য আর বিভিন্নতায় ভরে উঠবে আমাদের নতুন প্রজন্মের চিন্তা ও স্বপ্নের জগৎ। সুন্দর আগামীর জন্যই বাঁচাতে হবে এ প্রজন্মের শৈশব ও কৈশরকে।