বয়োঃসন্ধিকাল নিয়ে আর নয় কুসংস্কার
মানিকগঞ্জ সিংগাইর থেকে রিনা আক্তার
জন্ম থেকে মৃত্য পর্যন্ত একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জীবনচক্রের যে বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে সেখানে বয়োঃসন্ধিকাল অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটি পর্যায়। সাধারণত ১৩-১৯ বছরের মানুষ তথা টিনএজ বয়সের মানুষকে বয়োঃসন্ধিকাল পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও শারীরিক গঠন, খাদ্য অভ্যাস, আবহাওয়া, জেনেটিক কারণে সময়ের ভিন্নতা দেখে যায়, আবার লিঙ্গীয় পার্থক্যের কারণেও বয়োঃসন্ধিকালের সময়টি ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত এই সময়ের মধ্যে কিশোরদের শারীরিক গঠনের দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায়, মুখে দাড়ি গোফ বের হয়, গলার স্বরে পরিবর্তন আসে তেমনি কিশোরীদের ক্ষেত্রেও শারীরিক কিছু পরিবর্তন আসে। এদেশে সাধারণত ১১-১৪ বছর বয়সে কিশোরীদের জীবনে ঋতু¯্রাব নামক প্রাকৃতিক একটি ঘটনার অভিজ্ঞতা তৈরি হয় যা নিয়ে একজন নারীকে এক সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রতিমাসে নিয়ম করে ঘটনাটি ঘটে বলেই এটিকে ‘মাসিক’ নামে খুব সহজে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সাধারণত এর সময়কাল ধরা হয় ১২/১৩-৪৯/৫০ বছর।
বয়োঃসন্ধিকাল প্রতিটি মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের এক গুরুত্বপুণ পর্যায় হলেও আমাদের সমাজে সামাজিকভাবে বিষয়টিকে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখা হয়। সেই ব্যক্তিটি যদি হয় নারী তবে জন্ম থেকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে শুরু হয় তার উপর নেতিবাচক ধারণার প্রকাশ ও প্রয়োগ। নারীর এই নেতিবাচক ধারণার ব্যাপ্তি ও প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি হয় বয়োঃসন্ধিকালীন সময়ে নানাবিধ বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ভেতর দিয়ে। কিন্তু একজন মানুষকে জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার জীবনকালের মধ্যে এই সময়টিই অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। কেননা এই সময়টি একটি মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সময়েই তার শারীরিক গঠনের পাশাপাশি চিন্তা ও স্মৃতিশক্তি বিকাশের উপযুক্ত সময় যা তাকে চারপাশের সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে গভীরভাবে চিনতে বুঝতে ও অনুধাবন করতে সহযোগি হতে শেখায়। মানুষ হয়ে গড়ে উঠার এই পর্যায়ে একজন কিশোরীকে নানাবিধ পারিবারিক, সামাজিক বিধিনিষেধ, অবিশ^াসের দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রতিমুহুর্তে বিপদের আশংকা নিয়েই বেড়ে উঠতে হয়। ফলাফল হিসেবে চারপাশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধরণা আর অবিশ^াসের অবিরাম চর্চার ভেতর দিয়েই ঘটতে থাকে নারীর সামাজিকরণ প্রক্রিয়া।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রথম ঋতুস্রাব আগে শতকরা ৪১ ভাগ (তথ্যসুত্র: মিনোস্ট্রুয়াল হাইজিন ইন সাউথ এশিয়া) কিশোরী জানে না এটি কি এবং কেন? এই সময় পরিবার থেকে প্রতিটি কিশোরীকে বিভিন্ন বিধিনিষেধের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, এটি নারীর জীবনে অত্যন্ত গোপন বিষয়, তাই বিষয়টিকে লুকিয়ে রাখার জন্য প্রতিটি পরিবারে চলে প্রাণপন প্রচ্ষ্টো। যেন এটি নারীর জীবনে এক অদৃশ্য অপরাধ, তাকে সারাজীবন গোপন রাখতে হবে। শতকরা ৫৮ ভাগ (তথ্যসুত্র: মিনোস্ট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট ইন স্কুল,ইউনিসেফ) মানুষ মনে করে এগুলো দূষিত রক্ত, শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়াই ভালো, আর তাই এসময়ে মেয়েরা অপবিত্র থাকে। এ সময়ে মুক্ত উৎসের কোন পানি ব্যবহার করে নিজেদের পরিচ্ছন্নতা এবং ব্যবহৃত কাপড় পরিষ্কার করায় কিংবা টয়লেট ব্যবহারেও রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা ও কুসংস্কার। এই পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ খানিকটা এগিয়ে থাকলেও ২০২১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ (তথ্যসুত্র: বাংলাদেশ প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল) কিশোরী মাসিকের বিষয়টি গোপন রাখছে এবং ঋতু¯্রাব সবসময়েই জনসমক্ষে আলোচিত বিষয়ের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। স্কুলে মেয়েদের অনিরাপদ প্যাড ব্যবহার, আলাদা টয়লেট, পানি সরবারহ এবং পরিবর্তনের জন্য আলাদা স্পেস না থাকায় কিশোরীদের ঝরেপড়া, বাল্যবিয়ে, ও মাসিকের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য নানাবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়, এজন্য প্রতিবছর বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে বড় একটি অংশ জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। মাসিক যেহেতু সর্বদাই একটি অবহেলিত বিষয়। তাই সদা হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটিকে রাতারাতি হতে হয় গৃহবন্দী আর সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজেকে অপবিত্র মনে করে আড়ালে লুকিয়ে রাখে। যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে তার বেড়ে ওঠার ব্যক্তিত্বে,অন্তর্মূখতা বাসা বাঁধে চরিত্রে। ধর্মীয় গোড়ামী কিংবা সামাজিক শৃঙ্খলই কেবল এজন্য দায়ী বিষয়টি এতটা সরল সমীকরণ নয়। এর অন্তর্নিহিত মূল প্রোথিত রয়েছে পুরুষতন্ত্রের শেকড়ের অনেক গভীরে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই বিষয়ে আলোচনার অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এই সকল কুসংস্কার কিশোরী কিংবা নারীদের সামগ্রিক জীবনযাপনে এক বিরাট অন্তরায়। যার প্রভাব পড়ছে পরিবার, কর্মক্ষেত্রে এবং গোটা সমাজ জীবনে। শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিশেষ করে কো এডুকেশনে এই বিষয়গুলো বেশি বিঘিœত হচ্ছে। স্বাস্থ্যগত সমস্যা সচেতনতা ও ফ্যাসিলিটিজের অভাবে ব্যাক্তিগত হাইজিন ব্যবস্থাপনা বিঘিœত হয়, যা কোনভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয় ফলে নানারকম ভ্যাজাইনাল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয় অতি সহজে। প্রজনন স্বাস্থ্য কিংবা স্বাস্থ্যসেবা ইস্যুতে সঠিক তথ্যের অভাবে যথাযথ পরামর্শ, অবকাঠামোগত সুযোগ ও স্বাস্থ্যসম্মত দ্রবাদি ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
আজকের কিশোরীরাই কালকের মা। অনাগত প্রজন্মের সুপুষ্ট বীজ লুকিয়ে আছে যার অভ্যন্তরে তাদের যেন এ্ই অতি প্রাকৃতিক শারীরিক বিষয়ের অজ্ঞানতা নিয়ে বিভ্রমে পড়তে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা সকলের দায়িত্ব। সমাজে মাসিক নিয়ে যে কুসংস্কার ছড়িয়ে আছে সেটা দূর করতে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। আপনার আমার মায়ের, বোনের, স্ত্রীর কিংবা কন্যার যেমন মাসিক হয়, ঠিক তেমনি অন্য মেয়েদেরও হয়। এই স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তনের ফলেই আপনার আমার জন্ম হয়েছে। তাই মাসিকের সময় মেয়েদেরকে মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। আর সরকারের উচিত গ্রাম পর্যায়ে, বিশেষ করে কিশোরীদের মাঝে মাসিক নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আরো উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও প্যাডের ব্যবস্থা করা। তবেই আমরা একটি সুস্থ মায়ের সাথে সুস্থ সমাজ গড়তে পারবো।