করোনাকালীনে পুকুর সঠিক ব্যবস্থাপনায় লাভবান যুবক ইজদানি রাব্বী
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
শিল্পায়নের ফলে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে আমাদের দেশের কৃষি জমি, সাথে বাড়ছে ভূমিহীনের সংখ্যাও। মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলায় বর্ধিত জনসংখ্যার দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে কৃষিজমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাসস্থান, রাস্তা, বাজার ও শিল্পকারখানা। কৃষকের ফসলি জমির মালিকানা চলে যাচ্ছে মূনাফা লোভীদের দখলে। মুনাফা লোভী ব্যক্তিরা অধিক মুনাফার আশায় কৃষি জমিগুলো ব্যবহার করছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এমন অবস্থায় প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মালিকানায় থাকা কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারে। অনেকে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সাফল্যও পেয়েছেন।
আমি আজ এমনই একজন সফল উদ্যোগী যুবক মদনপুর ইউনিয়নের নরেন্দ্রনগর গ্রামের ইজদানী রাব্বীর (২০+) কথা বলছি। বাড়িভিটাসহ ইজদানীর সর্বমোট জমির পরিমাণ ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে পুকুর রয়েছে ১৫ শতাংশ। ইজদানী রাব্বী ছোট বেলা থেকেই কৃষক বাবার সাথে কৃষি কাজ করে আসছেন। ইজদানী রাব্বী নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করে কোন চাকুরি পাচ্ছিলেন না। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। দ্ইু বোন নেত্রকোনা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী। বাবা পেশায় কৃষক ছিলেন। এক সড়ক দুর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে বাবা কৃষিকাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। এমন অবস্থায় তাদের সংসার টিকিয়ে রাখায় দায় হয়ে পড়ে। সংসার ঠিকিয়ে রাখতে ইজদানী তাই কিছু একটা উপায় খুঁজতে থাকেন। দৈবক্রমে তিনি বারসিক’র সাথে পরিচিত হয় এবং যুব ও নারীদের জন্য সরকারের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর প্রদত্ত বিভিন্ন দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মকর্ম সংস্থানে সহযোগিতার বিষয় জানতে পারেন। ইজদানী রাব্বী বারসিক’র কর্মীর নিকট আত্মকর্মসংস্থানে সহায়ক এমন দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের আগ্রহের কথা জানান।
ইজদানীর জীবনে আসে সেই সুযোগ লাভ করেন এক পর্যায়ে। বারসিক’র সহযোগিতায় ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নেত্রকোনা জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর আয়োজিত তিন মাস মেয়াদী ‘মৎস্য চাষ ও ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ে দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণে তিনি অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ থেকে লব্ধ জ্ঞান তিনি তাদের নিজস্ব ১৫ শতাংশের পুকুরে মাছ চাষ ও পুকুর পারের জমিতে সবজি চাষে প্রয়োগ করেন। কিন্তু তা থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালানো খুব কষ্টকর হয়ে পরে। এদিকে বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এক্ষেত্রে কোন উপায় না দেখে ইজদানী আবারও বারসিক’র স্মরণাপন্ন হন। বারসিক’র সুপারিশে ইজদানী রাব্বী ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ পান। ঋণ পেয়ে করোনাকালীন লকডাউনের সময়ে সে পুরোপুরিভাবে কৃষি কাজের সাথে যুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী (‘প্রতিটি ইঞ্চি মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি’) ইজদানী অন্তরে ধারণ করে একটি পুকুর এবং পুুকুর পাড়ের প্রতিটি ইঞ্চি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর কাকা হায়দার জাহান চুন্ন’র ১৮ কাঠা বা এক একর ৮০ শতাংশ জমির একটি পুকুর (পুকুর পারে ১০০টি আমের চারাসহ) লিজ নিয়ে পুকুর পাড়ে স্থানীয় জাতের পেঁপে চারা রোপণ করেন। পেঁপের পাশাপাশি পুকুরের পাড়ে চাষ করেছেন বৈচিত্র্যময় সবজির
পুকুর পাড়ের চাষকৃত সবজির মধ্যে-শীতলাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা ও শসাসহ মৌসুম ভেদে বিভিন্ন ধরনের সবজি। এসব সবজি তিনি পুকুর পাড়ে মাদা করে বীজ রোপণ করেছেন এবং পুকুর পারে মাঁচা করে চাষ করছেন। আর পুকুরে চাষ করেছেন স্থানীয় জাতের মাছ যেমন- কৈ, শিং, মাগুর, পুটি, মলা, ঢেলা, পাবদা, স্বরপুটি, কার্পু, রুই, কাতলা, মৃগেলসহ হরেক জাতের মাছ। ইজদানি রাব্বী মাছ ও সবজি চাষের পাশাপাশি পুকুর পাড়ে কাকা’র রোপণকৃত ১০০টি উন্নত জাতের আমের চারার যতœ নেন। গত আমের মৌসুমে সে ২০ মণ আম বিক্রি করেছে এবং নিজেরাও খেয়েছেন। এক বছরে পুকুর থেকে মাছ, পেঁপে, আম ও সবজি বিক্রি করে তার আয় হয়েছে প্রায় এক লক্ষ টাকার বেশি। আয়ের টাকা থেকে তিনি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে বোনদের লেখাপড়ার খরচ ও পাঁচজনের সংসারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন।
আত্মকর্মসংস্থানে সাফল্যের কাহিনী বলতে গিয়ে ইজদানি রাব্বী বলেন, ‘চাকরী না পেলে হতাশ না হয়ে যদি বাড়ি চারপাশে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা উৎপাদনমূলক কাজে সঠিক পরিকল্পনা করে ব্যবহার করা যায় তাহলে সাফল্য অনিবার্য। পরিকল্পনা মাফিক জমি ও পুকুরের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি ব্যবহার করতে পারলে তাতে সোনা ফলানো সম্ভব। এক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করতে হলে বৈচিত্র্যময় জাতের সবজি, ডাল, মসলা ও মাছ চাষ করতে হবে, তবেই প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব। আমি শীত মৌসুমে সবজি, পুকুরের চারপাশের পাড়ে বিনা চাষে মাসকলাই চাষ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার প্রতিটি লাউ গাছে গড়ে ১০টি করে লাউ ধরেছিল। মোট ৩০০টি লাউ আমি প্রতিটি গড়ে ৩০ টাকা দরে ৯০০০ টাকায় বিক্রি করেছি। এক বছরে আমি একাত্তোর হাজার টাকায় পুকুর পাড়ের সবজি বিক্রি করেছি। আর এ সবজি উৎপাদনে আমার সর্বমোট খরচ হয়েছে মাত্র দশ হাজার টাকা।’
১৮ কাঠা বা এক একর ৮০ শতাংশ জমির পুকুরের পাড়ে ইজদানী মাসকলাই এর চাষ করেছেন। মাসকলাই খুব সুন্দর হয়েছে, মাসকলাই’র ফলন ভালো হবে বলে তিনি আশাবাদী। তিনি সারাদিন পুকুরের পাড়ে চাষকৃত বৈচিত্র্যময় সবজি ও ফলের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটান। তিনি জমিতে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না। জমিতে শুধুমাত্র গোবর ও কম্পোস্ট সার ব্যবহার করেন। শাকসবজিতে রোগবালাই দেখা দিলে বারসিক’র পরামর্শ অনুযায়ী ছাই, তামাকপাতা, গো-মূত্র, নিমপাতা, বিষকাটালী পাতা ইত্যাদি ঔষধি উদ্ভিদ দিয়ে জৈব বালাইনাশক তৈরি করে সবজির জমিতে ব্যবহার করেন
ইজদানী রাব্বী জানান, তাঁর চাষকৃত সবজি, মাছ ও পেঁপে বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যেতে হয় না, গ্রামের লোকেরা এবং স্থানীয় পাইকাররা বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যায়। বাজারের চেয়ে বাড়িতে এগুলোর দামও বেশি পাওয়া যায়। তিনি শুধুমাত্র মাছ ও সবজি চাষের উপর নির্ভরশীল নয়। বাড়িতে তিনি সারাবছর ১০০-২০০টি হাঁস ও ১০০টি মুরগি পালন করেন। এছাড়াও তাঁর ৫টি ছাগল ও ৫টি গরু রয়েছে। তার বাড়িটিকে প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর একটি পুষ্টিবাড়ি বলা যায়।
ইজাদানী রাব্বীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, তিনি তার জমির প্রতিটি ইঞ্চি সর্বদা চাষের আওতায় রাখবেন এবং বৈচিত্র্যময় ফসলের বীজ নিজেই সংরক্ষণ করবেন ও গ্রামের অন্য কৃষকদেরকেও উদ্বৃত্ত্ব বীজ বিতরণ করবেন। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত নিরাপদ খাদ্য ভোক্তাদের যোগান দেবেন। ইজদানীর মত দেশের সকল বেকার যুব সমাজ যদি চাকরির পেছনে অযথা সময় ও অর্থ নষ্ট না করে সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে প্রদত্ত দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে দেশের বেকার সমস্যা যেমন দূরীভূত হবে, তেমনি যুবদের বিপথে যাওয়াও রোধ হবে। আমরা ইজদানীর সার্বিক মঙ্গল কামনা করি।