পাহাড়ি ঢল থেকে শাকসব্জির রক্ষায় বস্তায় সব্জি চাষ

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে আল্পনা নাফাক
নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী একটি ছোট গ্রাম বনবেড়া। এ গ্রামে গারো ও হাজং এ দুই জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। নাহাজন হাজং একজন হাজং জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। বয়স ৫৪ বছর। স্বামী-স্ত্রী, ২ ছেলে ও এক মেয়ে এই ৫ সদস্যের একটি পরিবার। পেশায় তিনি একজন কৃষক ও দিনমজুর।
২০১২ সালে বারসিক এই বনবেড়া গ্রামে কার্যক্রম শুরু করে। সেসময় থেকেই তিনি যুক্ত হন বারসিক’র কাজের সাথে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তার কর্ম উেেদ্যাগ দেখে তাকে শাকসব্জি চাষের জন্য প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহযোগিতা করা হয়েছিল ২০১২ সালে। সহযোগিতার ফলে তিনি শাকসব্জি চাষ করে বিক্রি করেন। আগের তুলনায় বেশ লাভবানও হয়েছেন।কিন্তু সমস্যা হয় বর্ষাকালে। পাহাড়ি ঢলের কারণে অনেক শাকসব্জি তার নষ্ট হয়ে যেত।


সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের সময় অনেক শাকসব্জি তাঁর নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বর্ষাকালে শাকসব্জি চাষ করার জন্য আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাঁর এ সমস্যা দূর করার জন্য বারসিক ২০১৫ সালে পাহাড়ি ঢল থেকে রোপণকৃত শাকসব্জি রক্ষায় বস্তা পদ্ধতিতে শাকসব্জি চাষের জন্য কিছু সিমেন্টের খালি বস্তা সহযোগিতা করা হয়। সেই বস্তায় তিনি বারোমাসি মরিচ, ডিম বেগুন ও বারোমাসি শিংনাথ বেগুন চাষ করেন। ঐ বছর পাহাড়ি ঢল হলো কিন্তু তার এসব সব্জির কোন ক্ষতি হলো না। বস্তায় রোপণকৃত মরিচ ও বেগুন গাছ থেকে তিনি একাধারে ২ বছর মরিচ ও বেগুন সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। এমনকি মরিচ শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে পেরেছিলেন। সে সময় থেকে তিনি এখন পর্যন্ত বস্তায় মরিচ, বেগুন ও চালকুমড়া রোপণ করে আসছেন এবং এতে করে তাঁর কোন সমস্যা হয়নি।


নাহাজন হাজং এ বছর নিজ উদ্যোগে ৭০টি বস্তায় ৩ জাতের মরিচ রোপণ করেছেন। আরো কিছু চারা রোপণের জন্য তাকে বারসিক থেকে আরো ৫০টি বস্তা সহযোগিতা করা হয়। এ বস্তায় তিনি মরিচ, বেগুন, চালকুমড়া, পুইশাক চাষ করেছেন। বস্তা পদ্ধতিতে শাকসব্জির চাষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ি ঢল থেকে শাকসব্জি রক্ষার জন্য বস্তা পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো। বর্ষাকালে সরাসরি মাটিতে শাকসব্জি রোপণ করলে পাহাড়ি ঢলে শাকসব্জি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বস্তায় শাকসব্জি চাষ করার ফলে এখন আর পাহাড়ি ঢলেও শাকসব্জি নষ্ট হয় না।’


বর্তমানে মরিচের দাম কম থাকায় মরিচ বিক্রি না করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করছেন। নাহাজন এর স্ত্রী সারথী হাজং বলেন, ‘বস্তায় শাকসব্জি চাষ করার ফলে সারাবছরই শাকসব্জি পাওয়া যায়। বাড়তি শাকসব্জি বাজারে নিয়ে বিক্রি করে সংসারের অন্যান্য চাহিদাগুলো পূরণ করি। দীর্ঘদিন ধরে ফল ধরে বস্তায় শাকসব্জি চাষ করলে শুকনো মৌসুমে নিয়মিত পানি দিলে অনেকদিন পর্যন্ত থাকে।’ নাহাজন এর বাগান দেখে বনবেড়া গ্রামের অনেকেই এখন বস্তায় শাকসব্জি চাষ করছেন। প্রয়োজনে তিনি বস্তায় মাটি ভরার যে কৌশল বা পদ্ধতি সেগুলো বলে দিয়ে সহযোগিতা করেন। শুকনো মৌসুমে সেচের সমস্যায় পড়তে হয় তাকে। তারপরও পাহাড়ি ছড়া থেকে পানি এনে শাকসব্জি করেন নাহাজন হাজং। বর্তমানে তার রোপণকৃত মরিচের প্রায় সব গাছেই ফল ধরতে শুরু করেছে। কয়েকদিন পর আরো বেশি পরিমাণে মরিচ সংগ্রহ করতে পারবেন। ৬২টি মরিচ গাছে ফল ধরছে।
জৈব পদ্ধতিতে শাক সব্জি চাষের জন্য তিনি কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করেন। কেচো কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য তাকে ২০১৭ সালে একটি ছোট হাউজ তৈরি করে দেওয়া হয়। এই হাউজ থেক উৎপাদিত কেঁচো কম্পোস্ট তিনি শাকসব্জি রোপণের জন্য ব্যবহার করেন এবং ধানী জমিতেও ব্যবহার করেন।


নাহাজন হাজং এর প্রতিবেশী কামনা হাজং বলেন, ‘নাহাজন হাজং বস্তায় সব্জি চাষ করেন। তিনি লাভবান হয়েছেন। অনেকের শাকসব্জি পাহাড়ি ঢলে নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু তাঁর বস্তায় চাষ করার কারণে নষ্ট হয় না। তার দেখাদেখি গত বছর থেকে আমিও বস্তায় পুইশাক, মরিচ ও বেগুন রোপণ করেছি। গত বছরের পাহাড়ি ঢলে আমার সব্জি নষ্ট হয়নি।’


জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ও অভিযোজনের জন্য সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদের ব্যাপক আকারে বস্তায় শাকসব্জি চাষ করা প্রয়োজন। এ পদ্ধতিই হতে পারে বর্ষা মৌসুমে শাকসব্জি চাষের একটা অন্যতম পদ্ধতি, যা পাহাড়ি ঢল থেকে শাকসব্জি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

happy wheels 2

Comments