নিরাপদ খাদ্য: কর্পোরেট কোম্পানির মুনাফা বনাম জনস্বাস্থ্য

সিলভানুস লামিন

সাধারণত খাদ্যকে সুস্বাস্থ্যের মৌলিক উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়; ক্ষতিকারক নয়। তবে সারা বিশ্বের নিরাপদ খাদ্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে যে, অনেক সময় খাদ্য মানুষের স্বাস্থ্যের হন্তারক। খাদ্য মানুষকে আহত করতে পারে, অসুস্থ করে তুলতে পারে এমনকি হত্যাও করতে পারে-সেই খাদ্য যদি হয় অনিরাপদ ও ভেজাল!

আজ পৃথিবীজুড়ে খাদ্য বিষক্রিয়া বা খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে; বেশি লাভ বা মনুাফা করার উদ্দেশ্য থেকে জন্ম নিয়েছে খাদ্যবিষক্রিয়া বা খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসদ্বিচ্ছা। বলা হয়, সারাবিশ্বে কর্পোরেট খাদ্য বাণিজ্য শুরুর পর থেকে খাদ্যবিষক্রিয়া বা খাদ্যে ভেজাল মেশানোর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য মানুষের শক্তি যোগায়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, সুস্বাস্থ্য করে তুলে এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে-এটাই খাদ্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তবে বর্তমানে খাদ্যের সেই বৈশিষ্ট্য অনেকক্ষেত্রে আর থাকছে না। আর এ জন্য খাদ্য নিয়ে বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত অসমবাণিজ্যকেই দায়ি করেছেন অনেকে। বাণিজ্যিক খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে বিশ্বব্যাপী অস্বাস্ব্যকর বা অনিরাপদ খাদ্য নিয়ে ব্যাপক তোলাপাড় শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালে চীনে দুধের সাথে মেলামাইন নামক এক রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে। মেলামাইন মিশ্রিত দুধ পান করে সেদেশের ৬ জন শিশু মৃত্যুবরণ করে এবং ৩ লাখ শিশু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মান সরকার সেদেশের চার হাজার পশু খামারকে সীলগালা করেছে কারণ এসব খামারে উৎপাদিত পশু খাদ্যের সাথে ডাইঅক্সিন ((Dioxin) নামক একটি উপাদান পাওয়া গেছে, যা ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। একইভাবে যুক্তরাজ্যের খাদ্যচক্রের সাথে Campylobacter, নামক একটি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যা পাতলা পায়খানা, তলপেটের ব্যথা এবং বমিসহ নানান রোগ সৃষ্টি করে।

download

এছাড়া আধুনিক কৃষির কীটনাশক, রাসায়নিক সার এবং অন্যান্য উপাদান খাদ্যকে বিষক্রিয়া করার ক্ষেত্রে কোন অংশে কম দায়ি নয়। আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে এই যে, বিশ্বব্যাপী অনিরাপদ বা ভেজাল খাদ্য ছড়াছড়ির পরও এই পরিস্থিতি মূল্যায়ন বা অনিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত সংঘটিত ঘটনা তদন্ত করার মতো বিশ্বস্বীকৃত কোন ব্যবস্থা নেই। তাই অনিরাপদ খাদ্য সরবরাহের হার এবং এর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য নেই। তবে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ (Singaporean authorities) কর্তৃক পরিচালিত ২০১১ সালের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ১.৫ বিলিয়ন মানুষ অনিরাপদ খাদ্য খেয়ে নানান রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং এদের মধ্যে ৩ মিলিয়ন প্রতিবছর অনিরাপদ বা ভেজাল খাদ্য খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।

কী কারণে পুষ্টি ও শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত খাদ্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়ছে? এর কতকগুলো কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অস্বাস্থ্যকর অনুশীলন (নিম্ন স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি, প্রাণী সম্পদের অপব্যবহার, কীটনাশক ও এন্টিবায়োটিক’র ওপর অতিনির্ভরতা), খাদ্য প্রস্তুতে অপ্রমাণিত ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তির ব্যবহার (জেনেটিক রূপান্তর, নানোটেকনলজি, তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহার এবং ক্লোনিং), উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দূষণ (ভোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে খাদ্য পরিবর্তন করা) এবং খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দুর্বল তদারকির কারণে খাদ্য ভেজাল বা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক সময় অনিরাপদ হয়ে পড়ছে।

খাদ্যবিষক্রিয়ার বিষয়ে ক্ষুদ্র আকারের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার তুলনায় কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা বেশি দায়ি। কারণ বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার মানদণ্ড রক্ষা কিংবা জনস্বাস্থ্য দেখার তুলনায় মুনাফা অর্জনকে বেশি প্রাধান্য দেয়। কোন কারণে যদি এসব কোম্পানির খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দূষণ হয় কিংবা তাদের খাদ্যে ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায় তাহলে সারাবিশ্বে এটি ছড়িয়ে পড়ে। কারণ এসব কোম্পানি সারাবিশ্বে খাদ্য সরবরাহ করে থাকে বিধায় তাদের দূষিত বা ভেজাল খাদ্য বিশ্বের খাদ্যচক্রের সাথে মিশে যায়। এছাড়া বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার সম্প্রসারণ, বিশালাকৃতি, একচেটিয়া বাণিজ্য এবং কোম্পানিগুলো কর্তৃক চর্চিত ক্ষমতা-অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের অন্যতম বিষয় বলে ধারণা করা হয়েছে। অন্যদিকে ছোট আকারের দেশীয় খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থায় অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে থাকলেও তা নিদির্ষ্ট একটি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং এই উৎপাদনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করাও তুলনামূলকভাবে সহজ।

সারাবিশ্বে অনিরাপদ এবং ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের ভূমিকাও কোন অংশে কম নয়। কারণ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই দেশীয় খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থাকে আমলে না নিয়ে কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থাকে প্রবর্তন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে যত ধরনের আমলাতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার সেটির বাস্তবায়নে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই তো কৃষকের লোকায়ত জ্ঞান কর্তৃক পরিচালিত কৃষিজ উৎপাদনকে উপেক্ষা করে তারা আধুনিক কৃষির প্রবর্তনে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়।

মানুষের স্বাস্থের জন্য খাদ্যকে অনিরাপদ করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা যেসব উপাদানকে দায়ি করেছেন বিশেষ করে কীটনাশক, হরমোন, রাসায়নিক সার, মেলামাইন, ডাইঅক্সিন-এসবই কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান; লোকায়ত খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার নয়। তাই তো খাদ্য সম্পর্কিত বিশ্বের বিভিন্ন সরকার যেসব নীতিমালা, আইন, গাইলাইন প্রণয়ন করে সেগুলো কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার সম্প্রসারণে বেশ ভূমিকা পালন করে; কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর স্বার্থহানি হবে এমন ধরনের আইন ও নীতিমালা দেখাই যায় না!

এমনও দেখা যায়, বিশ্বে ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সম্প্রসারণের পেছনে লোকায়ত খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থাকে দায়ি করা হয় এবং যারা এই লোকায়ত খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার সাথে জড়িত তাদেরকে ‘অপরাধী’ হিসেবে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালানো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কলম্বিয়ার সরকার শহর এলাকায় কাঁচা দুধ বিক্রি নিষেধ করে এমন একটি আইন অনুমোদন করতে যাচ্ছে শুধুমাত্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে খুশি করার জন্য এবং দেশটির দুধ উৎপাদনব্যবস্থাকে ‘আধুনিক’ করে গড়ে তোলার জন্য। অথচ দেশটির প্রায় ২০ লাখ কৃষক ও ফেরিওয়ালা এই কাঁচা দুধ বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করে এবং দেশটির প্রায় দুই কোটি মানুষ বিশেষত যারা দরিদ্র এই কাঁচা দুধ ক্রয় করেই তাদের পরিবারের জন্য সবচে’ সহজলভ্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করার চেষ্টা করে।

অনিরাপদ ও ভেজাল খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো কেবলমাত্র মানুষের স্বাস্থ্য ও প্রাণীহানি ঘটায়নি সাথে সাথে বিশ্বের প্রাণবৈচিত্র্য নির্মূলেও সমান ভূমিকা পালন করছে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে এই বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে যে, কারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? জনস্বাস্থ্য ও প্রাণবৈচিত্র্য বড় নাকি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা এবং এর সহযোগী কর্পোরেট কোম্পানিগুলো?

ছবি সংগৃহীত

happy wheels 2

Comments