নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ চাই
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
রপ্তানিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া সচল রাখা, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নিম্ন আয়ের মানুষরা। সংবিধানের অন্যতম অঙ্গীকার-বাসস্থান ও স্বাস্থ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য অর্জন, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হলে এই নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এজন্যই আসন্ন বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন বিশেষ করে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন।
আজ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র যৌথ উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে “নগর পরিবেশ ও নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা”-শীর্ষক সেমিনারে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ বরাদ্দের উপরোক্ত দাবি জানিয়েছেন আলোচকরা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের সঞ্চালনায় সেমিনারে আলোচনা করেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আব্দুস সোবহান, ডাকসুর সাবেক জিএস ও স্বাস্থ্য আন্দোলন নেতা ডা. মোস্তাক হোসেন, পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী, লায়ন রাশেদ হালদার, ডা. খালেদ শওকত আলী, স্থপতি জোবাইদা গুলশান আরা, পবার সহ-সম্পাদক ব্যারিষ্টার নিশাদ মাহমুদ, বস্তিবাসীদের প্রতিনিধি রাফেজা বেগম, ঝুমুর বেগম,আয়েশা বেগম প্রমূখ। সেমিনারে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন বারসিক’র সহযোগী সমন্বয়কারী মো. জাহাঙ্গীর আলম।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, ‘সরকার নানান ধরণের উদ্যোগ নিলেও পরিবেশ বিপর্যয় কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। পরিবেশ বিপর্যয় ও তার অভিঘাতের অন্যতম শিকার হলো ঢাকাসহ নগরগুলোর নিম্ন আয়ের মানুষ। এই নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাই পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয় কি হতে পারে এই নিয়ে বিশেষভাবে আমাদের ভাবা প্রয়োজন।’ তারা আরও বলেন, ‘আমরা জানি ঢাকা শহরের বস্তির সমস্যা প্রকট। প্রায় ৫ হাজার বস্তি রয়েছে এ শহরে ৪০ লাখেরও অধিক নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাস করে। আমরা এই নগরের বসবাসকারী মানুষরা দেখতে পাই নগরের এই ব্যাপক অংশ মানুষদের জীবন হলো খুবই নাজুক। তাদের জন্য নেই আবাসন, সঠিক পয়োঃনিষ্কাসন ব্যবস্থা এবং তাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হলো সবথেকে বেশি। এই ব্যাপক অংশ জনসাধারণকে পরিকল্পিতভাবে বসবাস ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে এই শহরের পরিবেশগত সংকট এবং তাদের জনস্বাস্থ্য এমন নাজুক অবস্থাতেই থাকবে। তাই উক্ত পরিস্থিতিতে দরকার সরকারের তড়িৎ ভিত্তিতে বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।’
আলোচকরা বলেন, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে আমাদের মাথাপিছু আয়। আমরা এসডিজি পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ঢাকা শহরের বস্তিবাসীর জীবনে এইসব উন্নয়নের কোন প্রভাব পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। এই শহরকে বাঁচাতে হলে এবং আমাদের ভালো থাকতে হলে অবশ্যই বস্তিবাসীদের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ পাল্টাতে হবে। কারণ তাদের বেঁচে থাকা ও সুস্থ থাকার উপরই এ শহরের অনেক কিছুই নির্ভর করে। নগর এবং গ্রামের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানাবিধ প্রাকৃতিক আপদ যেমন; বন্যা, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, শৈত্যপ্রবাহ, লবণাক্ততা কারণে মানুষ জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে ভিড় করছেন। ফলে সহজ লভ্যতার কারণে তাদের অধিকাংশেরই জায়গা হচ্ছে শহরের অপরিকল্পিত এবং অপরিচ্ছন্ন ঘিঞ্জি বস্তিতে ও ফুটপাতের খোলা ভাসমান জায়গায়। প্রাকৃতিক দূর্যোগের প্রভাব শহরের বস্তিবাসীর জীবনকে অসহনীয় করে তুলছে।’
জানা যায়, ঢাকা শহরের বস্তিগুলোতে সারাবছরই থাকে মশার উৎপাত। অধিকাংশ বস্তিতে বর্ষাকালে পানি উঠে যায়। তাদের চলাচল করতে হয় দূষিত পানি কাঁদার মধ্য দিয়ে। যখন বেশি বৃষ্টিপাত হয় তখন বস্তিবাসীদের ঘরের মধ্যে ময়লা অবর্জনাসহ পানি উঠে যায়। ইটের উপর ইট দিয়ে পরিবারের জিনিসপত্র কোন রকমে রক্ষার চেষ্টা করেন তারা। শুধুমাত্র ২০১৭ সালের বৃষ্টির কারণে ঢাকা শহরের অধিকাংশ বস্তি এলাকা পানিতে ডুবে যায়। শহরের বৃষ্টির পানি নিষ্কাষনের সময় অধিকাংশ বস্তিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এবং বস্তিবাসী মানুষের ঘরের মধ্যে ময়লাযুক্ত পানি উঠে যায়। ডুবে যায় তাদের টয়লেট, বাথরুম, রান্নাঘর, পানির কল, রাস্তাঘাট।
উল্লেখ্য যে, ঢাকার অধিকাংশ বস্তির পরিবেশ অত্যন্ত দুর্গন্ধময়, অপরিচ্ছন্ন ও ঘিঞ্জি। সিটি করপেশেনের সেবা এখানে তেমন একটি নেই। এখানে পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। গবেষণায় দেখা গেছে, বস্তিতে প্রতিটি ল্যাট্রিন/টয়লেট গড়ে ১৫০-২০০ জন মানুষ ব্যবহার করে যা কোনভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হন। তাছাড়া তাদের অল্প আয়, নিম্নমানের তৈলযুক্ত খাবার গ্রহণ, অসচেতনতা, চিকিৎসার অভাব এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার কারণে দ্রুতই তাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। ফলে তারা ডায়রিয়া, কলেরা, জ্বর, কাঁশি, গ্যাস্টিক, হাঁপানি, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টায়ফয়েড, কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং তাদের আয়ের অধিকাংশ টাকা খরচ করে ফেলে। গবেষণায় পাওয়া গেছে, তাদের আয়ের বড় অংশ অর্থাৎ ৭৪ ভাগ টাকা খরচ হয় চিকিৎসা খাতে। গবেষণায় ৩১ ভাগ উত্তরদাতা গ্রীস্মকালে জ্বর, নিউমোনিয়া, বমি গলা ব্যথার কথা বলেছেন। উত্তরদাতাদের ৩১.১ ভাগ বলেছেন গ্রীস্মকালে তারা ডায়রিযা রোগে আক্রান্ত হয় এবং চর্মরোগে আক্রান্ত হয় ৬ ভাগ। বর্ষাকালে চর্মরোগে আক্রান্ত হয় ২৫ ভাগ উত্তর দাতা, ২২ ভাগ উত্তরদাতা জ্বর, নিউমোনিয়া ও বমি রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও তারা মাথা ব্যাথা, বাত, গ্যাস্ট্রিকসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়। উত্তরদাতাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, তারা সারাবছর রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪০০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭৬০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করে থাকেন।