উচ্চবরেন্দ্র কৃষিপরিবেশ অঞ্চলে ‘কৃষক-নেতৃত্বে বেগুন জাতবৈচিত্র্য গবেষণা’
বারসিক-রাজশাহী থেকে মো. রায়হান কবির রঞ্জু ও বারসিক-ঢাকা থেকে এবিএম তৌহিদুল আলম
সারসংক্ষেপ
দক্ষিণ-পশ্চিম উচ্চবরেন্দ্র কৃষিপরিবেশ অঞ্চলের (২৪০৩৮´থেকে ২৪০৫১´উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮০১৫´থেকে ৮৮০২১´পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার কসবা ইউনিয়নের খড়িবোনা গ্রামে বিগত ২০২০ সালের রবি মৌসুমে কৃষকের জমিতে স্থানীয় জাতের ১৯টি বেগুন নিয়ে ‘কৃষক-নেতৃত্বে বেগুন জাতবৈচিত্র্য গবেষণা’ পরিচালিত হয়। বেগুনের আকার, গড় ওজন, পোকামাকড় ও রোগ-বালাই সংক্রমণ, পরিপক্কতার সময়, দীর্ঘসময় ধরে ফল ধারণ, স্বাদ ও বাজার চাহিদা বিবেচনায় স্থানীয় কৃষকরা কৈতুরী, তাল বেগুন ও মুক্তকেশী জাত সর্বাধিক পছন্দ করেছেন। দেশের গ্রামাঞ্চলের নানা প্রান্তে এখনও অনেক ধরণের বেগুনের স্থানীয় জাত বিদ্যমান যা কৃষি-পরিবেশ ভিন্নতায় চাষ উপযোগি এবং লাভজনক উৎপাদন করা সম্ভব।
ভূমিকা
বেগুন আমাদের একটি অতি জনপ্রিয় একটি সবজি যার আদি উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বহু জাতের বেগুন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে নানান ধরনের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের আবাদযোগ্য (ষড়পধষ ঈঁষঃরাধৎ) বেগুন যাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য (আকার, আকৃতিও বর্ণ) ফলনশীলতা, পরিবেশগত উপযোগিতা, পোকা ও রোগ-বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা, পুষ্টিমান, খাদ্যগুণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ যোগ্যতা ইত্যাদির দিক দিয়ে প্রচুর ভিন্নতা বিদ্যমান। বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন কৃষিপরিবেশ অঞ্চলে বেগুনের বিভিন্ন স্থানীয় জাত চাষের মধ্য দিয়ে এখনও টিকে আছে। ফলের আকৃতি অনুসারে গোলাকার বা ডিম্বাকার, লম্বা বা সরু ও খর্বকৃতির হলেও দেশীয় বেগুনের কিছু কিছু প্রজাতি রয়েছে যাদের বৈশিষ্ট্য হলো গাছ, ডাল, পাতা ও ফলে কাঁটা থাকে। কৃষকরা এই বিশেষ ধরনের জাতগুলো জমির আইলে ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রোপণ করে থাকেন।
গবেষণার উদ্দেশ্য, উপকরণও গবেষণা পদ্ধতি
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার কসবা ইউনিয়নের খড়িবোনা গ্রামে বিগত ২০২০ সালের রবি মৌসুমে বেগুনের স্থানীয় জাতের বৈশিষ্ট্যমূলক পরিচিতিতথ্য সনাক্ত ও লিপিবদ্ধকরণ, খরা ও রোগ-বালাই সহিষ্ণুতা, এলাকা ভিত্তিক চাষ উপযোগিতা পরীক্ষণ ও সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য দেশের ৬টি জেলা থেকে বেগুনের শীতকালীন জাত তাল বেগুন, ঘিওন বেগুন, ঘৃত কাঞ্চন বেগুন, লাফফা বেগুন, লম্বা দেশি বেগুন, চায়না বেগুন ও বারোমাসি জাত মুক্তকেশী বেগুন, ঝুরি বেগুন, লম্বা বেগুন, শিংনাথ কালো বেগুন, আনন্দ বেগুন, ডিম বেগুন, কৈতরী বেগুন, মোটা বোতল বেগুন, শিংনাথ সাদা, চালতে বেগুন, গুটি বেগুন, থোক বেগুন ও টব বেগুন এই ১৯ ধরনের জাত ‘কৃষক-নেতৃত্বে বেগুনজাতবৈচিত্র্য’ প্রায়োগিক কৃষিগবেষণায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বসতভিটা সংলগ্ন কৃষিজমিতে খড়িবোনা কৃষক ঐক্যের কৃষকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও জৈব চাষাবাদে পরিচালিত এই পরীক্ষণে গবেষণামূলক নকশা অনুসরণ করে সারি পদ্ধতিতে চারা থেকে চারা ৯০ সেন্টিমিটার ও সারি থেকে সারি একই দূরত্ব অনুসরণ করে প্রতি সারিতে নির্দিষ্ট জাতের ৫০টি করে চারা অক্টোবর মাসের শেষ দিনে রোপণ করা হয়। এর আগে একই মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজ তলায় অঙ্কুরোদগের জন্য বীজ বপন করা হয়। পাক্ষিক ভিত্তিতে সংগৃহীত সুনির্দিষ্ট তথ্য, গবেষণার সাথে সরাসরি যুক্ত কৃষকদল ও প্রতিবেশী গ্রামীণ জনগোষ্ঠির মতামত গবেষণার তথ্যও উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়।
ফলাফল পর্যালোচনা
সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সবচেয়ে আগে ৭৯ দিনে ফুল এসেছে লম্বা বেগুন ও আনন্দ বেগুন জাতে। আর সবশেষ ১১১ দিনে ফুল এসেছে ডিমবেগুন, ঝুরি বেগুন ও চায়না বেগুন এই তিনটি বেগুন জাতে। ৮২-৮৮ দিনে ফুল এসেছে লাফফা বেগুন, মোটা বোতল বেগুন, শিংনাথ কালো, গুটি বেগুন ও কৈতুরী জাতে। অন্যদিকে মুক্তকেশী জাতে ৯২ দিনে ফুল এসেছে। ৯৬-১০২ দিনে ফুল এসেছে তাল বেগুন, শিংনাথ সাদা বেগুন, ঘিওন বেগুন, চালতে বেগুন, টব বেগুন, লম্বা দেশি বেগুন, থোক বেগুন, ঘৃতকাঞ্চন বেগুন জাতে। মুক্তকেশী বেগুন, টব বেগুন ও থোক বেগুন সংগ্রহ উপযোগি পরিপক্কতা লাভ করেছে ১১০ দিনে। ১৩০ দিনে পরিপক্ক হয়েছে শিংনাথ কালো, লাফফা বেগুন ও ডিম বেগুন। তাল বেগুন, লম্বা বেগুন, ঘিওন বেগুন ও ঘৃতকাঞ্চন বেগুন ১১১-১১৭ দিনে পরিপক্কতা লাভ করেছে। ১১৮-১২৪ দিনে পরিপক্ক হয়েছে চায়না বেগুন, লম্বা দেশি বেগুন ও আনন্দ বেগুন। শিংনাথ সাদা বেগুন, কৈতুরী বেগুন, চালতে বেগুন, মোটা বোতল বেগুন, ঝুরি বেগুন ও গুটি বেগুন সবশেষে ১২৫-১২৮ দিনে পরিপক্কতা লাভ করেছে।
পরীক্ষণে অন্তর্ভূক্ত জাতের মধ্যে ডিম বেগুন আকারে সবচেয়ে ছোট যার দৈর্ঘ্য মাত্র ১০ সেন্টিমিটার এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাত হলো শিংনাথ কালো। এই জাতের ফলের দৈর্ঘ্য ২৬ সেন্টিমিটার। ১২ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য পাওয়া গেছে মোটা বোতল বেগুন, ঝুরি বেগুন, চালতে বেগুন, ঘিওন বেগুন, গুটি বেগুন, থোক বেগুন, লম্বা দেশি বেগুন, তাল বেগুন, টব বেগুন, চায়না বেগুন, থোক বেগুনও ঘৃতকাঞ্চন বেগুন জাতে। আর ১৯-২৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের বেগুন জাতগুলো হল লম্বা বেগুন, লাফফা বেগুন, আনন্দ বেগুন, কৈতুরী বেগুন ও শিংনাথ সাদা বেগুন। একই ভাবে শিংনাথ কালো জাতের ফলের সর্বনি¤œ ব্যাস পাওয়া গেছে ৯ সেন্টিমিটার আর অন্যদিকে সর্বোচ্চ ব্যাস পাওয়া গেছে ২৯ সেন্টিমিটার ঘিওন বেগুন জাতে। ফলের ব্যাস ১০ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার এর মধে রয়েছে মুক্তকেশী বেগুন, ঝুরি বেগুন, লম্বা বেগুন, শিংনাথ সাদা বেগুন, লাফফা বেগুন, আনন্দ বেগুন, কৈতুরী বেগুন, ডিম বেগুন ও থোক বেগুন। অন্যদিকে ফলের ব্যাস ১৭ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার হলো ঘৃতকাঞ্চন বেগুন, চালতে বেগুন, চায়না বেগুন ও মোটা বোতল বেগুন। একই ভাবে টব বেগুন, গুটি বেগুন ও তাল বেগুন জাতে ২৪ থেকে ২৮ সেন্টিমিটার ফলের ব্যাস পাওয়া গেছে।
তাল বেগুন জাতের গড় ওজন ৩২২ গ্রাম যা পরীক্ষাধীন সবগুলো জাতের চেয়ে বেশি। এরপরই ৩১০ গ্রাম গড় ওজন পাওয়া গেছে টব বেগুন জাতটিতে। ফলের গড় ওজন ৪৬-৬০ গ্রামের মধ্যে মুক্তকেশী বেগুন, ঝুরি বেগুন, লম্বা বেগুন, লম্বা দেশি বেগুন জাতে। অন্যদিকে ৭৬-৯৬ গ্রাম গড় ওজনের ফল পাওয়া গেছে লাফফা বেগুন, শিংনাথ কালো বেগুন, আনন্দ বেগুন ও ডিম বেগুন জাতে। কৈতুরী বেগুন, মোটা বোতল বেগুন, শিংনাথ সাদা বেগুন ও চায়না বেগুন জাতের ফলের গড় ওজন ১১৮-১৩৫ গ্রাম। আবার ১৪৫-থেকে ২৫২ গ্রাম গড় ওজন হলো চালতে বেগুন, গুটি বেগুন, ঘৃতকাঞ্চন বেগুন ও ঘিওন জাতের বেগুন। আর ২৮ গ্রাম যা সবনি¤œ গড় ওজন হলো থোক বেগুন জাতের। অপর দিকে গাছ প্রতিগড় ফলন ৭ কেজি ৪২২ গ্রাম যা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে তালবেগুন জাতে। এর পরে গাছ প্রতি গড় ফলন ৫ কেজি ৮৯০ গ্রাম টব বেগুন জাতে। গাছ প্রতি ৪ কেজির বেশি হল কৈতুরী (৪ কেজি ৯৫৫ গ্রাম), চালতে বেগুন (৪ কেজি ৪৪০ গ্রাম)। শিংনাথ জাতে গাছ প্রতি গড় ফলন পাওয়া গেছে ৩ কেজি ২৫ গ্রাম। বাকী জাতগুলিতে গাছ প্রতি গড় ফলন হল ১ কেজি ৫৬০ গ্রাম থেকে ২ কেজি ৭২০ গ্রামের মধ্যে। আর গাছ প্রতি সবচেয়ে কম গড় ফলন দিয়েছে থোক বেগুন যা ১ কেজি ২২০ গ্রাম মাত্র।
কৈতুরী বেগুন জাতে কোনো প্রকার পোকামাকড় আক্রমণ করেনি। মোটামুটি কম আক্রান্ত হয়েছে ঘৃতকাঞ্চন বেগুন, তাল বেগুন, ঝুরি বেগুন জাতে। বাকী সব জাতেই পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হয়েছে। কৈতুরী, মুক্তকেশী, শিংনাথ কালো, মোটা বোতল বেগুন, আনন্দ বেগুন, ঘৃতকাঞ্চন বেগুন জাতে তুলনামূলক কম পানি সেচ লেগেছে। বেগুনের পাতায় কাঁটা রয়েছে তাল বেগুন, শিংনাথ সাদা বেগুন ও ডিম বেগুন জাতে। তবে ডিম বেগুনের পাতায় কাঁটার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
ফলত্বকের কারণে বেগুনে স্বাদের তারতম্য হয় বলে কৃষকরা মতামত দিয়েছেন। মোটা ফলত্বক বিশিষ্ট বেগুনজাত অপেক্ষাকৃত কম স্বাদযুক্ত। কৃষকদের বিবেচনায় পরীক্ষাধীন জাতগুলোর মধ্যে খুব সুস্বাদু জাতগুলো হল ঘিওন বেগুন, শিংনাথ কালো বেগুন, লম্বা বেগুন ও ঘৃত কাঞ্চন বেগুন। আর সুস্বাদু হলো তাল বেগুন, কৈতরী বেগুন, লম্বা দেশি বেগুন, শিংনাথ সাদা, মুক্তকেশী, মোটা বোতল বেগুন, আনন্দ বেগুন ও চায়না বেগুন। কম সুস্বাদু জাতগুলো হল চালতে বেগুন, টব বেগুন, ঝুরি বেগুন, ডিম বেগুন ও থোক বেগুন। আর খুব কম সুস্বাদু হলো লাফফা বেগুন ও গুটি বেগুন কারণ এদের ফলত্বক সর্বাধিক পুরু।
সার্বিক ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাত ভিন্নতায় বাহ্যিক গঠন ও স্বাদ বেগুনের বাজার মূল্যের নির্ধারক। পরীক্ষাধীন জাতগুলোর মধ্যে কৃষকরা সর্বাধিক পছন্দ করেছেন কৈতরী বেগুন কারণ এই জাতের বেগুনের ফল দেখতে আকর্ষণীয়, খেতে সুস্বাদু, গাছ দৃঢ়, কোনো প্রকার পোকা-মাকড় আক্রমণ হয় না, দীর্ঘ সময় ধরে ফলন দেয় ও স্বাভাবিক সেচে চাষ করা যায়। এই জাতটির পরেই কৃষকরা পছন্দ করেছেন তাল বেগুন। বারোমাসি তাল বেগুন জাতের বেগুনের ফল আকারে বড় যা বাহ্যিকভাবে যেমন নজর কাড়ে তাই বাজার চাহিদাও বেশি। এই জাতটি ঘন করে লাগিয়েও চাষ করা যায়। তাল বেগুন গাছ হেলে পড়ে না, ফলও যেমন তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করা যায়, তেমনি খেতেও সুস্বাদু যা এলাকায় প্রচলিত মাসকালাই রুটির সাথে ভর্তা হিসাবে খুবই মুখরোচক। পোকার আক্রমণও মোটামুটি কম। কৃষকের তৃতীয় সর্বাধিক পছন্দের জাত হলো মুক্তকেশী। এই জাতের গাছে কান্ডের সংখ্যা বেশি তাই ফলও বেশি ধরে। ফল সুদৃশ্য ও খেতে সুস্বাদু। চাষাবাদে বাড়তি খাবারও সেচ তেমন প্রয়োজন হয় না। সে কারণে স্থানীয় কৃষকরা এই জাতটিও পছন্দ করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বেগুন জাতের নামকরণের সাথে এর উৎপাদন সময়, ফলধারণ, ফলের আকার, বর্ণ বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন তাল বেগুন তাল ও ডিম বেগুন ডিমের আকৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
উপসংহার
‘কৃষক-নেতৃত্বে’ পরিচালিত এই পরীক্ষণ থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নানা প্রান্তে এখনও অনেক ধরণের স্থানীয় বেগুন জাত বিদ্যমান যা ভিন্ন ভিন্ন কৃষিপরিবেশে চাষ উপযোগি এবং লাভজনক ভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব। সর্বাধিক পছন্দের জাতগুলো যেমন অধিকতর গবেষণার দাবি রাখে তেমনি বেগুনের এই জাতগুলো বিভিন্ন এলাকায় চাষের জন্য বীজ সহজলভ্য হলে বেগুনের আদিভূমি বাংলাদেশে বেগুনজাতবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।