দিনকে দিন প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিম্বজিৎ মন্ডল
‘এলাকাতে আগে নানান ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য ভরা ছিলো। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন কমতে শুরু করেছে। আগে এলাকাতে বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালী,স্থানীয় জাতে মাছ, বিভিন্ন ধরনের ফলজও বনজ গাছ,বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও প্রাণী ছিলো। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে শোনা যেতো শিয়ালের হাঁক। পৌষ অগ্রহায়ণ মাসের দিকে যেন নবান্ন উৎসব। ক্ষেতে নতুন ধান ওঠা, আর প্রত্যেক বাড়িতে যেন একধরনের গন্ধ। একদিকে চিনিকানি, দারশাইল ধানের গন্ধ অন্যদিকে খেজুরের রসের গন্ধ। খাওয়ারের মধ্যে ছিলো নানান ধরনের বৈচিত্র্য। আর যতো দিন যাচ্ছে যেন দিনকে দিন প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে।’
উপরোক্ত এমন কথাগুলো বলেছেন শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের কালমেঘা গ্রামের কৃষাণী আরতী রানী। গত ১০ ডিসেম্বর বারসিক’র সহায়তায় কালমেঘা গ্রামের কৃষাণী বনশ্রী রানীর লবণাক্ততা ও প্রাণবৈচিত্র্যের সমস্যা বিষয়ক গ্রাম পর্যায়ে আলোচনা সভায় তিনি একথাগুলো বলেন।
আলোচনা সভায় কালমেঘা গ্রামের কৃষক, কৃষাণী, শিক্ষার্থী, বারসিক কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জন অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, তাদের এলাকাতে আগে শকুন, চিল, বাদুড়, পেঁচা, টিয়া, বেনেবৌ, কাঠঠোকরা, শ্যামা, ময়না, বিভিন্ন ধরনের শালিক, মাছরাঙা, ঘুঘু, কোয়েল, বালহাঁস, গাংচিল, বাবুই, চড়–ই, বক, বাটাংসহ নানান ধরনের পাখি ছিলো। মাছের মধ্যে ছিলো স্থানীয় জাতের বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও লোনা পানির মাছ কৈ, শৈল, বোয়াল, লাটা, চ্যাং, উলকো, তোড়া, বাইন, মায়া, ঝায়া,টেপা, আড়টেংরা, চ্যালা, কাকশিয়াল, পুটি, খয়রা, মরকুল, লালটিক, সোনাঘটি, বিরকুল্লো, বিভিন্ন কাপ জাতীয়, ভোলা, গলদা, চিংড়ি, সাতহাতেসহ নানান ধরনের সামুদ্রিক মাছ।
অন্যদিকে তারা জানান, গাছের মধ্যে ছিলো বিভিন্ন ধরনরে বনজ গাছ হিমে, বাবলা, ঝাউ, খৈ, বট, শিশু, মেহগনি, ফলের মধ্যে ছিলো আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, কাঠবাদাম, বাদাম, গাব, আমড়াসহ নানান ধরনের ফলজ ও লবণের মধ্যে ছিলো কেওড়া, বাইন, গরান, গেওয়া, সুন্দরী,গোল সহা নানান ধরনের গাছ। বন্য প্রানীর মধ্যে ছিলো কাঠবিড়ালী, শিয়াল, গুয়েতাড়কেল, খাটাইস,বনবিড়াল, বনমুরগি, ইঁদুর, বানর, হরিণ, কচ্ছপ সহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। পোকামাকড়ের মধ্যে ছিলো কড়াপোকা, ডাঁস, নেদা পোকা, ঘুঘরো পোকা, প্রজাপতি, মশা, মুশুক, বাড়ে পোকা, জোনাকি, বিভিন্ন ধরনরে পিপড়াসহ নানা ধরনের পোকামাকড়।
তাদের মতে, বর্তমান সময়ে এসকল প্রাণবৈচিত্র্য কমতে শুরু করেছে। কিন্তু ফসল চাষের ক্ষেত্রে যেন পোকামাকড় আরও বাড়ছে। নানা ধরনের সার কীটনাশক ব্যবহার করেও এ কমানো যাচ্ছে না। তাদের পাশ^বর্তী ধুমঘাট এলাকার দিকে কিন্তু আবার পোকামাকড় কম কারণ সেখানে মিষ্টি এলাকা। এই বিষয়ে অংশগ্রহণকারী নারী অমিতা রানী মন্ডল বলেন, ‘আমাদের এলাকাতে এখন আর আগের মতো প্রাণী দেখা যায় না। এখন দেখার মধ্যে খাটাস, ইদুর, বেজি, কাঠবিড়ালী, চামচিকে আছে। এছাড়াও কচ্ছপ, শিং মাছ, বোয়াল মাছ, সোনালী টেংরা, বাইন মাছ ও জোঁক গুলো একেবারে হারিয়ে গেছে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে লবণ পানির বা চিংড়ি ঘেরের মাছ বিশেষ করে তেলাপিয়া, পাঙ্গাস মাছসহ বিভিন্ন ধরনের কাপ জাতীয় মাছ।’ তিনি আরও বলেন, প্রাণীসম্পদের মধ্যে রয়েছে টার্কি, পোল্ট্রি, বয়লার, সোনালী, পাকিস্তানি, অস্ট্রেলিয়ান মুরগি। কারণ এখন আমাদের এলাকায় ও এলাকার চারিপাশে লবণ পানির সাথে যেন সবদিক থেকে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন এই লবণ পানির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে। লবণের মধ্যে যা হয় সেগুলো চাষাবাদ বাড়ছে। এই লবণ পানি প্রবেশ করাতে মিঠা পানির মাছ, ফলজ গাছ, গবাদি পমু পাখি, ও প্রাণী সব কিছু কমতে শুরু করেছে।”
অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী মিনতী বালা বলেন, ‘বাপ দাদাদের কাছে শুনেছি আগে অনেক কিছু ছিলো। আজ এ সভার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে আরো কত কি ছিলো আমাদের এলাকাতে। কিন্তু এখনো মিষ্টি পানির অনেক জিনিস আমাদের এলাকাতে আছে। এলাকার প্রত্যেক বাড়িতে কম বেশি করে গবাদি পশু পাখি আছে। যদি লবণ পানি এভাবে বাড়তে থাকে তাহেলে এখন যেগুলো আছে সেগুলোও হয়তো আর দেখা যাবে না। লবণ পানির প্রবেশে হয়তো একদিন আমাদের এলাকা থেকে সব ধরনের প্রাণীকূল হারিয়ে যাবে।’ অংশগ্রহণকারীরা তাদের এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে প্রাণবৈচিত্র্যের যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা সমাধানের জন্য নিজেরা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এছাড়া আরো ভালোভাবে করার জন্য কিছু সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদান করেন যেমন: লবণ পানির চিংড়ি ঘের যা আছে সেগুলো রাখা আর না বাড়ানো। লবণ পানির চিংড়ি ঘেরের আউট ড্রেন রাখা। কালমেঘা ও কল্যাণপুর খান পুনঃখনন করা। অবাধে রাস্তা কেটে লবণ পানি না উঠানো। স্লুইস গেট মেরামত করা। স্লুস গেটে পানি উঠানো ও বের করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা। লবণাক্ততার প্রভাব ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা তৈরি ইত্যাদি।