পিরোজপুরের পাড়েরহাটে এক সকালে
পিরোজপুর থেকে ফিরে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
গিয়েছিলাম পিরোজপুর পারিবারিক ভ্রমণে। আমি যতবার পিরোজপুর গিয়েছি প্রায় ততবারই বৃষ্টি ছিল আমার সঙ্গী। এবারও বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পিরোজপুর পৌছালাম। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর মধ্যে পিরোজপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আমাকে বিমোহিত করে। প্রচুর বৃক্ষরাজি আর নদনদী অধ্যুষ্যিত এই জনপদ বসবাসের জন্য খুবই আরামপ্রদ। জেলা শহরের পাশ দিয়ে চলে গেছে বলেশ্বর নদী। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো কচা নদী।
যা হোক, এখনও বলেশ্বর নদীতে এখনো পাওয়া যায় হরেক রকম মাছ। এই নদীর ইলিশ এ জনপদে খুবই প্রসিদ্ধ। কথা হচ্ছিল পিরোজপুরের একজন প্রবীণ আইনজীবী মোশারেরফ হোসেন খান এর সঙ্গে। তিনি বলেন, “খুব ছোট্টবেলায় আমরা নদীর ধারে গেলে মানুষ বিনে পয়সায় মাছ দিয়ে দিতেন। এমনকি ২০-২৫টি ইলিশ মাছ আমাকে বিনে পয়সায় গ্রামের মৎস্যজীবীরা দিয়ে দিয়েছেন এমন ঘটনাও জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে।” তিনি আরো বলেন, “আগে নদীতে অসংখ্য প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো যা এখন দেখা যায় না। মানুষ বেড়েছে কিন্তু নদীতে মাছের পরিমাণ বাড়েনি। অসময়ে অনেক মানুষ ডিমওয়ালা মাছ মেরে ফেলে। তাই মাছ সংরক্ষণ ও তার বংশবিস্তারের জন্য সরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
আমরা একদিন পিরোজপুরের পাড়েরহাট গেলাম মাছ দেখা ও কেনার জন্য। পাড়েরহাট এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ একটি মাছের আড়ৎ। যেখানে সমুদ্র ও নদী থেকে মাছ এনে ডাকে বিক্রি করা হয়। ভোর ৬ টায় আমরা আড়ৎ এ উপস্থিত হলাম। একজন আড়ৎদার যার নাম ইকবাল শেখ আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। এত ভোর বেলাতেই নদীর ঘাটে প্রায়১০-১২টি মাছ ভরা ট্রলার এসে উপস্থিত। ট্রলার থেকে একে একে নামানো হচ্ছে ইলিশ, পোমা, জাবাবোল, ভেটকি, লইট্টাসহ অসংখ্য প্রজাতির মাছ। একেক জন মাছ এনে আড়ৎ এর সামনে রাখছেন আর সাথে সাথে ডাক শুরু হয়ে যাচ্ছে। মাছ কিনতে আসা ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীরা ডাকে সেই মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো এই হাট থেকে। এই সুযোগে আমিও কিছু মাছ কিনে নিলাম, বলা যায় সস্তা দামে।
ইকবাল শেখ তার এই মৎস আড়ৎ সম্পর্কে বলেন, “আমাদের পৈত্রিক ব্যবসা হলো মাছ। আমার ব্যক্তিগত ৬টি বড় মাছ ধরার ট্রলার আছে। একেকটি ট্রলার সমুদ্রে পাঠাতে প্রতি দশ দিকে প্রায় দুই লক্ষ টাকা আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়। তবে ইদানিং মাছের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। তবে সমুদ্র থেকে মাছ ধরার ক্ষেত্রে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না।”
তিনি আরো বলেন, “সরকার মাছ সংরক্ষণের অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যা বেশ কার্যকর হচ্ছে। তবে আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্যও কিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নানান ধরণের সমস্যা আমাদের প্রতিমূহূর্তে পোহাতে হয়। এর মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ একটি।”
একজন মাছ কিনতে আসা ব্যক্তি তরুণ সাহার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, বাজারের থেকে এখান থেকে মাছ কিনলে সস্তায় মাছ পাওয়া যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো সতেজ মাছ পাওয়া যায়।”
এবার আমরা ইলিশ আর জাবাবোল মাছ কিনে বাড়ি ফিরছি। আমাদের অটোওয়ালা ফরিদ তার গল্পের ঝাকি নিয়ে বলেই চলেছে। তার দাদা, তার বাবা তারা কেমন মাছ খেয়েছে, কতো প্রাচুর্য ছিল, কতো কিছু ছিল। আমি তন্ময় হয়ে শুনছি সেই পুরাণ দিনের কথার মতো করেই। আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি দিনদিন নষ্ট হচ্ছে। তাই হারিয়ে যাচ্ছে বৈচিত্র্য আর সম্পদের প্রাচুর্যতা। তাই মাছ কমছে, মাছের বৈচিত্র্যও কমছে। আসুন এই বৈচিত্র্য রক্ষায় সকলে উদ্যোগী হই। পাড়েরহাট বেঁচে থাকুক, বেঁচে থাকুক আমাদের স্বপ্নগুলো।