কৃষি বিপণন আইন ও তরমুজ প্রতারণা

পাভেল পার্থ
চৈত্রের খরতাপে দগ্ধ শহর। ঢাকার গলিতে গলিতে দাঁড়িয়ে আছে তরমুজ। কোনোটা কাহিল, কোনোটাবা চাঙ্গা। কীসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছে এত তরমুজ? ক্রেতা-ভোক্তার পিপাসার্ত জীবনের সুধা-সঞ্জিবনী নিয়ে? নাকি অমীমাংসিত ন্যায্যদামের হিস্যা নিয়ে? দগ্ধ নগরে অপেক্ষারত এই তরমুজ সারির কাছে নাগরিক হিসেবে আমরা কী চাই? মিষ্টিরসে ভরপুর রাঙা শরীর, নাকি তরমজুচাষীর ক্লান্ত দেহভার? কোথা থেকে আসে এত তরমুজ, দাঁড়ায় গলির দরজায়। বাংলা অঞ্চলের খাদ্য তালিকায় তরমুজ কীভাবে যুক্ত হয়েছে এ নিয়ে প্রাচীন দলিলের অভাব। তরমুজ নিয়ে আমাদের প্রতœজিজ্ঞাসা কেমন কেন জানে? বেগুনের আদি জন্মভূমি বা কান্ট্রি অব অরিজিন বাংলাদেশ। এক এক উদ্ভিদের উৎপত্তি দুনিয়ার এক এক অঞ্চলে। তরমুজের আদি উৎপত্তিস্থল কোথায় খুঁজতে গিয়ে দেখলাম এ নিয়ে দ্বিধা আছে। বলা হয়, পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ৫০০০ বছর আগে খরাসহিষ্ণু তরমুজ দুনিয়ায় ছড়িয়েছে। কালাহারি মরুভূমির আদিবাসীরা এর আদি ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। লিবিয়ার এক ঐতিহাসিক প্রতœস্থল উয়ান মুহুজ্জিয়াগে ৩৫০০ বছরের প্রাচীন তরমুজের বীজ পাওয়া গেছে। খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ সনেই মিশরে তরমুজ আবাদের কথা জানা যায়। শ্রেণিকরণবিদ ক্যারোলাস লিনিয়াস ১৭৫৩ সনে মিষ্টিস্বাদের তরমুজের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামকরণ করেন। সপ্তম শতকে ভারতীয় অঞ্চলে তরমুজ চাষ হয় এবং প্রায় দশম শতকে এটি চীনেও ছড়িয়ে পড়ে। করডোবাতে ৯৬১ সনে এবং সিভিলে ১১৫৮ সে তরমুজ চাষের কথা জানা যায় এবং পরবর্তীতে তরমুজ পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬০০ শতকে ইউরোপীয় ভেষজবিদ্যায় তরমুজের উল্লেখ পাওয়া গেলেও ইউরোপে ১৭ শতক থেকে বাগানের এক অনুল্লেখযোগ্য ফসল হিসেবে এটি চাষ হতে শুরু করে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় হাজার জাতের তরমুজ আবাদ হয়। বাংলাদেশের মানুষ এখনো তরমুজের ভেতরটা লাল আর বাইরেটা সবুজ এতেই অভ্যস্ত। কবি পুর্নেন্দু পত্রীর আবার তরমুজ দেখলে সবুজ শাড়ি পড়া নন্দিনীর কথা মনে আসে। কিছুদিন আগেও একটা গোটা আস্ত তরমুজ বিক্রি হতো রাস্তায়। ক্রেতার সন্দেহ দূর করতে ধারালো ছুরি দিয়ে দুম করে ফেঁড়ে দেয়া হতো তরমুজের পেট। সবুজ শরীরের থেকে উঁকি মারতো লাল শাঁস। এমনকি ফালি করে কাটা তরমুজও বিক্রি হতো মফস্বলে, স্কুলের সামনে। হঠাৎ করে তরমুজ বিক্রিতে একটা পরিবর্তন এলো, ওজন করে তরমুজ বিক্রি শুরু হলো। করোনা মহামারিকালে দেখা গেল ৫ কেজি ওজনের একটা তরমুজ গলির মুখ থেকে ২০০/২৫০ টাকার কমে কেনা যাচ্ছে না। ওজন না পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি হবে এ নিয়ে শোরগোলও তৈরি হলো নাগরিক জীবনে। গণমাধ্যম কী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু তরমুজ তর্কের সুরাহা হলো না। জানা গেল, গলির মুখ থেকে তরমুজ কিনে ঠকছে ক্রেতা-ভোক্তা। কৃষকের কোনো লাভ হচ্ছে না। জমিন থেকে শহরের গলির মুখ তরমুজের এই যাত্রাপথে মুনাফা লুটছে সেই একদল মধ্যস্বত্ত্বভোগী। যাদের কবল থেকে এখনো কৃষক, ক্রেতা, ভোক্তা, বিক্রেতা কারোর মুক্তি মিলেনি। সমাজ, রাষ্ট্র, আইন কী মিডিয়া কেউ তাদের রুখতে পারেনি। মধ্যস্বত্বভোগীদের এই দৌরাত্ম অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।


দৈনিক সমকালে ২০২২ সনের ৯ এপ্রিল ‘তরমুজের লাভ কারা খায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, ১০ টাকা কেজি দরের তরমুজ ঢাকার রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। তরমুজের ফিরিস্তি দিয়ে শুরু হলেও চলতি আলাপখানি ফসলের ন্যায্যমূল্য ও এর সামাজিক তদারকি প্রসঙ্গকে আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তরমুজ ন্যায্যদামেই ক্রেতা-ভোক্তা খরিদ করতে চায়, একইসাথে তরমুজচাষীও যেন তার উৎপাদনের ন্যায্যমূল পায়। আমরা চাই না ফসল কিনে কেউ ঠকছে বা ফসলকে জিম্মি করে কেউ ঠকাতে পারে এমন ধারণা সমাজে প্রচলিত ও প্রশ্নহীন থাকুক। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মনের গহীনে খাদ্য ও ফসল নিয়ে এমন বিপদজনক সন্দেহ ও প্রতারণা জিইয়ে থাকুক তা আমরা চাই না। স্পষ্ট রাষ্ট্রীয় তৎপরতা ও সক্রিয় সামাজিক তদারকির ভেতর দিয়েই গলির মুখে দাঁড়ানো তরমুজের যাত্রাপথকে আমরা নির্বিঘœ করতে পারি। একটি তরমুজ ক্রয়ের মাধ্যমে কৃষক, বিক্রেতা, ক্রেতা, ভোক্তার ভেতর বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। আর এর ভেতর দিয়েই নিশ্চিত হতে পারে ন্যায্য বিপণন ও মানবিক বাজার।

বাংলাদেশের সবচে বেশি তরমুজ আবাদ হয় বরিশাল বিভাগে, মোট তরমুজ আবাদের ৬৫ ভাগই ফলে এখানে। এছাড়া খুলনা, সাতক্ষীরা, উত্তরাঞ্চল ও চরাঞ্চলেও তরমুজের আবাদ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিহালচার বিভাগের তথ্য দিয়ে সমকাল জানায়, চলতি মৌসুমে ৬৭ হাজার ৯৫২ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৩ লাখ ১১ হাজার ৯৮০ টন। ২০১৯-২০ মৌসুমে ৩৮,৮২৪ হেক্টর চমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছিল, ফলন হয়েছিল ১৪,৫২৫৯২ টন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৩৪,৬০৭ হেক্টর জমিতে ফলেছে ১৩,৬৭৩৫৬ টন তরমুজ। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৪৪,২৩৭ হেক্টর জমিতে ১৬,৯১২০৪ টন এবং ২০১৬-১৭ মৌসুমে ৪৫,৭৪২ হেক্টর জমিতে ফলেছে ২১,৯৫৯৩৯ টন তরমুজ। খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার প্রায় বিশটি গ্রাম জুড়ে আবাদ হয় তরমুজ। প্রশ্ন ওঠতে পারে এতো তরমুজ কী বিক্রি হয়? তরমুজ সুরক্ষিত রাখার কোনো মজুতকেন্দ্র বা গুদামঘরও নেই আমাদের। এমনকি তরমুজ থেকে কোনো নিরাপদ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও গড়ে তুলিনি আমরা। খুলনার ডুমুরিয়ার কৃষক মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল তরমুজ থেকে গুড় বানিয়েছিলেন। হয়তো তরমুজ চাষ, উৎপাদন, মজুতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এসব নিয়ে বহু গ্রামীণ লোকায়ত কারিগরি আছে। কিন্তু মূলধারার কৃষিপ্রকল্প কিংবা উন্নয়নচিন্তা কৃষকের এসব লোকজ্ঞান মূল্যায়ণ করে না। দূরে সরিয়ে রাখে, প্রণোদিত করে না। তো যা হয়, তরমুজ হোক বা তিল হোক চাষাবাদের যাবতীয় ঝুঁকি কৃষকইে নিতে হয়। তরমুজ বিক্রি হোক বা না হোক। বাজারে দাম যাই থাকুক বা না থাকুক। খরা, বন্যা কী বালাইয়ে ফলন নষ্ট হলেও কৃষককেই এর মূল্য দিতে হয়। আমরা যারা গপগপিয়ে রসালো তরমুজ গিলি এই ক্রেতা-ভোক্তার জানা জরুরি কৃষক বা কৃষির ঝুঁকি সামাল দিতে কিন্তু কখনোই তরমুজের দাম বাড়ে না। খরা বা শিলাবৃষ্টিতে জমিন নষ্ট হলে তরমুজের দাম বাড়ে না। সর্বস্ব দিয়ে চাষ করে আবাদের খরচ না ওঠাতে পারা কৃষকের দুঃখ লাঘবে তরমুজের দাম বাড়ে না। যারা তরমুজ চাষ করে কিংবা যারা তরমুজ কিনে খায় এরা কেউ তরমুজের দাম বাড়ায় না। তরমুজের দাম বাড়ায় কৃষক আর ভোক্তা বলয়ের একেবারে বাইরে থাকা একদল নির্দয় মধ্যস্বত্বভোগী।


কোনো শস্য, ফল, ফসল ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন, নথি ও প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা কী? কোন প্রতিষ্ঠান কৃষিফসলের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে কাজ করে? কৃষকের জমিন থেকে বাজার তদারিক করে? কেউ আইন ভঙ্গ করেছে কীনা তা দেখভাল করে? কৃষক, ক্রেতা-ভোক্তা কেউ মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের জন্য ঠকছে কীনা তা দেখে? ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে হয়তো গরিষ্ঠভাগেরই জানা নেই, কৃষিফসলের বিপণন বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তর’। জনগণের করের টাকায় চলা এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ দেশের কৃষিফসলের ন্যায্য বিপণন নিশ্চিত করা। চাইলেই কেউ ১০ টাকার তরমুজ ৫০ টাকায় বিক্রি করতে পারে না। তরমুজের মূল্য নির্ধারণ এবং ন্যায্য বিপণন নিশ্চিত করাই এই অধিদপ্তরের কাজ। কৃষি বিপণন বিষয়ে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা দৃশ্যমান না হলেও এর ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৩৪ সনে বিপণন বিভাগ তৈরির প্রস্তাব হয় এবং ১৯৩৫ সনে বিপণনকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৫৪ সনে কৃষি, সমবায় ও ত্রাণ অধিদপ্তরে কৃষি বিপণন যুক্ত হয়। ১৯৬০ সনে কৃষি বিপণন পরিদপ্তরের বিভাগ, জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়। তখন ‘এগ্রিকালচার প্রডিউস মার্কেট রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৬৪’ এর মাধ্যমে কৃষি বিপণন নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৯৮২ সনে কৃষি বিপণন পরিদপ্তর থেকে এটি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে উন্নীত হয়। কিছু সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধি দ্বারা ন্যায়সঙ্গত কৃষি বিপণন নিশ্চিত করা এই দপ্তরের কাজ। এর ভেতর গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘কৃষি বিপণন আইন ২০১৮’ এবং ‘কৃষি বিপণন বিধিমালা ২০২১’। কৃষি বিপণন বিধিমালা ২০২১ অনুযায়ী রাষ্ট্র তরমুজসহ প্রায় প্রতিটি কৃষিফসলের একটা ন্যূনতম মূল্য, যৌক্তিক মুনাফার হার ও বিপণনের বিধি ঘোষণা করেছে। তরমুজ একটি ফল এবং উৎপাদক পর্যায়ে এর যৌক্তি মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০%। পাইকারী পর্যায়ে ২০% এবং খুচরা পর্যায়ে ৩০%। রাষ্ট্রীয় এই আইনের অংক কষে সমকাল জানায়, একটি তরমুজ ২০ টাকার কাছাকাছি কেজি হতে পারে, কিন্তু কৃষকের কাছ থেকে তরমুজ কিনে তিন হাত ঘুরে এলাকাভেদে তরমুজের দাম দশ গুণ বেড়ে যায়। মধ্যস্বত্ত্বভোগী ব্যবসায়ীরা জ্বালানির মূল্য ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়াসহ বিপণনের নানাবিধ সমস্যাকে দাম বাড়ার কারণ হিসেবে গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছেন। তরমুজ নিয়ে এমন প্রতারণা বন্ধ হবে কবে? কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী দেশে জাতীয় কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটি থেকে জেলা ও উপজেলা কমিটি থাকার কথা। ঢাকার গলিতে গলিতে বোঝাই তরমুজের ন্যায্য বিপণন নিশ্চিত করতে আশা করি বিপণন কমিটি সক্রিয় ও তৎপর হবে। তরমুজ বিপণনের গল্পের ভেতর দিয়েই হয়তো নতুন প্রজন্ম সত্যিকারের গণিত আয়ত্ত করবে। কৃষক, ক্রেতা-ভোক্তা, বিক্রেতার সম্পর্ককে আন্দাজ করবে। মধ্যস্বত্ত্বভোগী আর প্রতারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নীতিকে তৎপর হতে গণআওয়াজ জোরালো করবে।

happy wheels 2

Comments