বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে

বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে

ঘিওর, মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক:

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি…

রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুরের এই অনবদ্য কবিতার মতোই দূষণ আর মানুষের লোভের ফাঁদে পড়ে অনেক নদীই আজ কেবল ইতিহাস। স্মৃতির প্রিয় স্রোতস্বিনী কালীগঙ্গাও হারিয়েছে তাঁর সোনালি যৌবন। এক সময়ের উচ্ছাস প্রলয়ংকারী কালীগঙ্গার বর্তমান এই হাল। পাশাপাশি দেশের প্রায় বিপদাপন্ন সব নদ-নদীর জন্য একই শোকগাথা।

আর দেশের অন্যতম প্রধান নদী ধলেশ্বরীতে এখন আর শুশুক ভাসেনা! গাঙ কলাও জন্মায়না! নৌকা থেকে লাফ দিয়ে চলে যাওয়া রুপালি মাছগুলোর মতন নদীর স্বপ্নও বা হারিয়ে গেছে চিরতরে! তাই তো পানির বদলে নদী বক্ষে শোভা পাচ্ছে সবুজ শ্যামল শস্যের সমারোহ।

নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। কিন্তু নদী কেন্দ্রিক সেই ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, কৃষি, অর্থনীতি ক্রমশই হয়ে আসছে সংকুচিত।

Ghior, Manikgonj Rive-1ঘিওর ও দৌলতপুর মানিকগঞ্জের এ দুটি উপজেলা। নদী-খাল-বিল পরিবেষ্টিত ও কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চল। একসময় যমুনার পানি ধলেশ্বরী নদী দিয়ে ঘিওর, বেউথা, হরিরামপুর হয়ে নবাবগঞ্জের সিরাজদীখান পর্যন্ত প্রবাহিত ছিল। লঞ্চ-স্টিমার, মালবাহী কার্গোও এ নদীতে চলেছে। এখন ধলেশ্বরী প্রায় মৃত নদী। বর্ষা মৌসুমে কিছু পানি কালীগঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত হলেও ধলেশ্বরীতে বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, একসময় ঘরে বসেই তারা ধলেশ্বরীর পানি প্রবাহের শব্দ শুনেছেন। পাল তোলা নৌকা চলেছে। মাঝি-মাল্লাদের গানে মুখরিত থাকত নদীর দুই পাড়। এখন এসব কিছুই শুধু স্মৃতি।

মানিকগঞ্জ জেলায় এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। নদী দুটি আজ মৃতপ্রায়। এই নদীকে দখল, দূষণমুক্ত এবং রক্ষা করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে মানিকগঞ্জ ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন ও বেসরকারী উন্নয়ন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকসহ সচেতন ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। কালীগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর বুক জুড়ে কেবলই বালুর ভান্ডার। এককালের বেগবান নদী বক্ষে গড়ে উঠেছে বিশাল চর। গভীরতা না থাকায় নদী দুটিতে বর্তমানে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর বুকে এখন বোরো আবাদ হচ্ছে। এলাকাবাসী নদী দুটি দ্রুত খননের দাবি জানিয়েছেন।

ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও অন্দোলন নেতা বিমল রায় জানান, “দৌলতপুর থেকে ঘিওর পর্যন্ত পুরনো ধলেশ্বরীতে পানি প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। খাল দখল, ভরাট ও বাঁধ দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নদীর বুকে বালি জমে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ভরা বর্ষায় কালীগঙ্গায় কিছু নৌকা চললেও ধলেশ্বরীতে সম্ভব হচ্ছে না। ধলেশ্বরীকে বাঁচাতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, দ্রুত খনন ও বালি অপসারণ করা অতীব জরুররী।

Ghior, Manikgonj Riverপানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, মাঝ নদীতে বিশাল চর জেগে ওঠায় নদীর গতিপথে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। দৌলতপুরের কাছে যমুনা থেকে কালীগঙ্গা নদী উৎপন্ন হয়ে জাবরার কোল ঘেঁষে সিঙ্গাইরের ধল্লা পর্যন্ত এ নদীটির বিস্তৃৃত। এর দৈর্ঘ্য ৪৫ কিলোমিটারের বেশি। বর্তমানে এই নদীর অধিকাংশ স্থানে শুকনো মওসুমে নৌকা চলার মতো পানিও থাকে না। কোথাও কোথাও একেবারেই শুকিয়ে গেছে। চলছে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ। হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বালু ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে এটি মৃতপ্রায়। কেবল বর্ষা মৌসুমে একটা সরু ধারা প্রবাহিত হয়।

মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মামুন উর রশিদ বলেন, “মানিকগঞ্জে প্রবহমান নদীগুলো মরে যাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্যসহ সর্বত্র এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।”

happy wheels 2

Comments