লক্ষ্মী রাণীর জীবন-স্বপ্ন-সংগ্রাম
মানিকগঞ্জ থেকে এ্যাডভোকেট দীপক কুমার ঘোষ
নাম তার লক্ষী রাণী সরকার। বয়স ৯০। দুই পুত্র সন্তানের মা। স্বামী দেহত্যাগ করেছেন অনেকটা বছর হলো। বুকভরা স্বপ্ন, সুন্দর একটি সংসার আর স্বামী-সন্তান নিয়ে জীবন গড়ার আকাংখায় বিয়ে হয়েছিল লক্ষীদীর। বানিয়াজুরী গ্রামে স্বামীকে দেবতাতুল্যে মালা দিয়ে সাতপাকে বেঁধে এসেছিল নতুন সংসারে। ঘর আলো করে সন্তান এলো। দু:খ কষ্টে তাদের বড়ও করলেন। তারপর একে একে স্বপ্নগুলো ভেঙে যেতে থাকলো লক্ষীদী’র।
ঐতিহ্যবাহী বানিয়াজুরী ইউনিয়নের কাউন্সিলে যেতে সবুজ দুর্বাদলে ঢাকা মখমলের মত দুর্বা মাড়িয়ে বাজার ঘেষে কাউন্সিলে শরৎ উৎসবে যোগদিতে যাচ্ছি, পেছন থেকে ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালাম। দাদা এককাপ চা খেয়ে যান। ঘুরেই দেখি লক্ষী রাণী ডাকছেন।
কয়েক বছর আগে বানিয়াজুরী রথ উৎসবে গিয়েছিলাম। লক্ষ্মী রাণী দিদির ঘরে দিদির হাতে বানানো চা খেয়েছিলাম- সে কথা দিদি মনে রেখেছেন। তাঁর আমন্ত্রণ ফেলতে পারলামনা। নিজ হাতে চা বানিয়ে খাওয়ালেন দিদি-পরম মমতায়। দিদির পাশে বসে চা খেতে খেতে জানলাম দিদির জীবন আলেখ্য।
স্বপ্ন নিয়ে ঘর বেধেছিলেন। স্বামী চানাচূর বিক্রি করতেন হাটে-হাটে। বিক্রিবাট্টা ছিল ভালো। দিদি বানাতেন, দাদা নিয়ে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। দুই সন্তানকে বড় করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন। বিধি বাম; স্বামী ফাঁকি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল। হঠাৎ সংসারে নেমে আসে অভাবের ছায়া। দিদির স্বপ্নমেঘে ঢেকে যায়। চারিদিকে অন্ধকার। থামলেন না দিদি।
বাজারে দোকান নিলেন। চা-চানাচুর-পান বিক্রি করে ছেলেদের সংসারে স্বামীর ভিটায় নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু করলেন লক্ষ্মী রাণী দিদি। বৈধব্যের বেদনা, স্বপ্ন ভাঙার হতাশা কোনোটাই দিদিকে থামাতে পারেনি। ৯০ বছর বয়সেও দিদি এখনো নিজ হাতে চা বানিয়ে বিক্রি করে উপার্জন করে মাথা উচু নিয়েই গর্ভে ধরা পুত্রদের সংসারে বেঁচে আছেন দিদি।
তাই পড়ন্ত বিকেলে শরৎ উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে লক্ষ্মী রাণী দিদির প্রাণের ডাক ফেরাতে পারিনি। দিদির হাতে বানানো দিদির দোকানে বসে চা খেয়ে যে তৃপ্তি পেয়েছি কোনোদিন ভুলবো না। আর দিদির মুখে জীবন সংগ্রামের মহাকাব্য শুনেছি তা আমার কাছে কিংবদন্তি হয়ে থাকবে আজীবন। লক্ষ্মী রাণী দিদি আপনাকে হাজার প্রণাম। বেঁচে থাকুন হাজার বছর।